সিলেটে প্রাথমিক শিক্ষায় চরম সংকট, তিন বছরে ৩৩১ শিক্ষক বরখাস্ত

উন্নত জাতি গড়তে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট বিভাগে সেই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা এখন গভীর সংকটে। শিক্ষক সংকট, প্রশাসনিক দুর্বলতা, ও বিদেশমুখী প্রবণতায় শিক্ষার গুণগত মান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় ১ হাজার ৯৩২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই কোনো প্রধান শিক্ষক, আর সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে ২ হাজার ৪৮৯টি। ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

হাজারো শিক্ষক বিদেশে, পাঠদান বিপর্যস্ত

শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে শিক্ষকদের বিদেশমুখিতা। সরকারি চাকরি পাওয়ার পরও ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডাসহ উন্নত দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেক শিক্ষক।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে (২০২২–২০২৫) ছুটি না নিয়েই বিদেশে চলে যাওয়ার অভিযোগে ৩৩১ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও ৪৭ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান। বরখাস্ত হওয়াদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি সিলেট জেলা, এরপর সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারহবিগঞ্জ

শূন্য পদে বিপর্যয়

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যমতে, সিলেট বিভাগের চার জেলার ৫ হাজার ৫৪টি বিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষক শূন্য
এর মধ্যে—

  • প্রধান শিক্ষক শূন্য : ১,৯৩২টি পদ

  • সহকারী শিক্ষক শূন্য : ২,৪৮৯টি পদ

বিভাগীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী—

  • সিলেট জেলায় ৭,৮৬৭ পদের বিপরীতে শূন্য ৭৩০টি

  • সুনামগঞ্জে ৭,২৫৮ পদের বিপরীতে শূন্য ১,০২৮টি

  • হবিগঞ্জে ৫,৪২৫ পদের বিপরীতে শূন্য ৪৩৭টি

  • মৌলভীবাজারে ৫,৩৩৯ পদের বিপরীতে শূন্য ২৯৪টি

অন্যদিকে প্রধান শিক্ষকের পদে—

  • সিলেট জেলায় ৭৭৮টি শূন্য

  • সুনামগঞ্জে ৩৬৫টি

  • হবিগঞ্জে ২৪৬টি

  • মৌলভীবাজারে ৫৪৩টি শূন্য পদ রয়েছে।

বিদেশে গিয়ে বরখাস্ত

বিভাগীয় অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চার জেলায় ৩৭৮ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছুটি না নিয়ে বিদেশে যাওয়ার অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়। এর মধ্যে ৩৩১ জন বরখাস্ত এবং ৪৭ জনের মামলা তদন্তাধীন

শুধু সিলেট জেলায়ই মামলা হয়েছে ১৬৩ জনের বিরুদ্ধে; ১৪০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। হবিগঞ্জে মামলার সংখ্যা ২৯, বরখাস্ত ২২ জন।

একাধিক শিক্ষক পরিবার-পরিজন নিয়ে ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পরও মাসের পর মাস সরকারি বেতন-ভাতা তুলেছেন, যা তদন্তে প্রকাশ পায়।

অফিসে জনবল ঘাটতিও প্রকট

শিক্ষক সংকট ছাড়াও চার জেলায় অফিস সহকারী, এমএলএসএস ও নৈশপ্রহরীসহ প্রশাসনিক কর্মচারীর এক হাজারের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। এতে বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমেও জটিলতা দেখা দিয়েছে।

‘কয়েক মাসে সমাধান আসবে’

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উপপরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন,

“এত বেশি সংখ্যক শিক্ষকের পদ খালি থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। অন্য শিক্ষকদের ওপরও চাপ বাড়ছে।”

তিনি আরও বলেন,

“মামলাজনিত জটিলতা কেটে গেছে। ইতিমধ্যে পিএসসি প্রধান শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলার দিয়েছে। আশা করছি, কয়েক মাসের মধ্যেই প্রধান শিক্ষক সংকট দূর হবে। সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলারও প্রস্তুত রয়েছে।”

ছুটি না নিয়ে বিদেশে যাওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে তিনি বলেন,

“৬০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে বিভাগীয় মামলা হয়। যাদের বিদেশে থাকার প্রমাণ মিলেছে, তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।”

উপসংহার

সিলেট বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার এই সংকট শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি জাতীয় ভবিষ্যতের হুমকিও। দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ ও কঠোর তদারকি না হলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি আরও নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

- Advertisement -

এই বিভাগের আরও সংবাদ