বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ: হুমকিতে বাঙালির ঐতিহ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা

এসএম আশরাফুল ইসলাম: একসময় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি খাল, বিল, নদী, পুকুর ছিল দেশীয় মাছের আধার। শৈলখালি, পদ্মপুকুর, গাবুরা, নলতা কিংবা তালা—সব জায়গাতেই মাছ ধরা ছিল নিত্যদিনের চিত্র। এখন সেই দৃশ্য ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের শৈলখালি গ্রামের জেলে আনিছুর রহমান প্রতিদিন খালে জাল ফেলেন- আশা করেন কিছু মাছ মিলবে। কিন্তু জাল তুললে কেবল হতাশা। পানির নিচে এখন আর জীবন নেই, আছে শুধু নীরবতা। বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মাছ শুধু খাদ্য নয়, জীবনের অংশ। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’- এই পরিচয় আজ বিলুপ্তির মুখে। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, এক সময়ের সাধারণ মাছ- রয়না, বাইম, সরপুটি, পাবদা ও তারা বাইম এখন বিলুপ্তপ্রায়। কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, পুঁটি, চ্যাং- যে মাছগুলো একসময় গ্রামের খাল-বিলে অবাধে পাওয়া যেত, এখন সেগুলো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
দেশীয় মাছ কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ স্পষ্ট। প্রথমত, দেশের নদী-খাল-বিলের নাব্যতা দ্রুত হারাচ্ছে। নদী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের এক হাজার নদীর মধ্যে তিন শতাধিক নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। খাল-বিল ভরাট হয়ে গেছে ঘের, রাস্তা বা বসতবাড়ি নির্মাণে। ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাব। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র পর সাতক্ষীরার দক্ষিণাঞ্চলে নোনা পানি প্রবেশ করে ঘের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এখন প্রায় সারাবছরই ওই এলাকায় নোনা পানি থাকে। ফলে মিঠা পানির মাছের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তৃতীয়ত, কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মাছের ডিম ও রেণু ধ্বংস হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে এসব রাসায়নিক মিশে নদী-খালে পৌঁছে জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে।
চতুর্থত, অবৈধভাবে বিষ ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ ধরা এখনও বন্ধ হয়নি। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকাগুলোতে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এতে শুধু মাছ নয়, পুরো জলজ বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত হচ্ছে।
দেশীয় মাছ রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব দেখা যায় না। সাতক্ষীরা মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার মতে, “দেশীয় মাছ সংরক্ষণে ‘অভয়াশ্রম’ প্রকল্প থাকলেও পর্যাপ্ত তদারকি নেই। ফলে কিছুদিন পরই তা অকেজো হয়ে যায়।” স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের সম্পৃক্ততাও সীমিত।
অন্যদিকে, ঘের মালিকরা উৎপাদন বাড়াতে ঘেরে নোনা পানি তোলেন, যা প্রাকৃতিক জলাশয়ের ভারসাম্য নষ্ট করে। খাল-বিল বদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মা মাছ ডিম ছাড়ার জায়গা পায় না। এক সময় যে খাল দিয়ে মাছ সহজে নদীতে যেত, এখন তা ইটবালি ফেলে বন্ধ হয়ে গেছে। দেশীয় মাছ শুধু ঐতিহ্যের অংশ নয়, এটি বাঙালির পুষ্টির অন্যতম উৎস। পুষ্টিবিদদের মতে, দেশীয় ছোট মাছ যেমন পুঁটি, মলা, কাচকি বা টেংরা- এগুলো ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) হিসাব অনুযায়ী, মৎস্যচাষ অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় ৬০ শতাংশ নারী ও শিশু আয়রন ও আয়োডিন ঘাটতিতে ভুগছে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম জানান, আমিষের ঘাটতিতে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, রাতকানা, দাঁতের সমস্যা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের প্রবণতা বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পুষ্টি নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, অথচ সেই নদীগুলো এখন মাছশূন্য। খাল-বিলগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, মাছের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির পরিচয়ও। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এখন কেবল প্রবাদে সীমাবদ্ধ। দেশীয় মাছ রক্ষা মানে শুধু এক প্রজাতি বাঁচানো নয়- এটি এক সংস্কৃতি, এক ঐতিহ্য, এক জাতির খাদ্যনিরাপত্তা বাঁচানো। আজ যদি আমরা উদ্যোগ না নিই, আগামী প্রজন্ম জানবেই না- পুঁটি মাছ দেখতে কেমন ছিল, কিংবা বর্ষার সকালে খালে জাল ফেলার আনন্দ কতটা ছিল।

- Advertisement -

এই বিভাগের আরও সংবাদ