দাদু বারান্দায় বসে আছেন। আম গাছের ফাঁক গলে এক টুকরা রোদ এসে পড়েছে দাদুর গায়ে। শীতের সকাল। হেমন্তের শেষের দিকে সামান্য শীত আসে। দাদুর মন খানিকটা আনমনা। ডিসেম্বর এলে দাদুর মন এমন হয়। তিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। আজ পহেলা বৈশাখ। দাদু আজো তেমনি বিচলিত।
দাদু বলেন, কাছে বোস। তোর বাবার গল্প করি শোন।
যত্তিন থেকে বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই দাদু বাবার গল্প করে আসছেন। দাদুর গল্প বলা আমি মমনোযোগ দিয়ে শুনি।বাবার গল্প তো শুনতে ভালো লাগে। কষ্ট ও পাই অন্তরে। তবে কষ্টের চেয়ে অহংকার লাগে বেশি।আর গল্প যদি হয় গৌরবের তাহলে তো কথাই নেই। আমার বাবার গল্প অনেকটা বেশিই গৌরবের।
দাদু বলেন শোন তুই তখন মায়ের কোলে। নাদুস নুদুস ছিলি খুব। তোকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে দেশের যুদ্ধে চলে গিয়েছিলো তোর বাবা।দেশ রক্ষার যুদ্ধ। বর্বর পাকিস্তানের হাত থেকে মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধ। তাই যাওয়ার সময় বাঁধা দেই নাই।
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছে আমার বাবা জানা নেই। তোর বাবা ভীষণ সাহসি ছিলো। শুনেছি ভারতে গিয়ে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল পাকদের সাথে যুদ্ধ করতে।
প্রায় নয় মাস যুদ্ধ করেছিলো। ডিসেম্বর এলে যুদ্ধ জয়ের সুবাতাস শোনা যাচ্ছিল।
দাদু বলেন, আমার গর্বে বুক ভরে উঠত। রেডিওর খবর শুনে। আমার একটা রেডিও ছিলো সব সময় কানে রাখতাম। আমার ছেলের খবর বলে কিনা জানার জন্য। আমাদের জয়ের খবর বলে কিনা তাও জানার জন্য।
তোর দাদি রাতদিন কান্নাকাটি করতো কবে ফিরে আসবে তার ছেলে।
তোর মা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো তোর বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায়। তোর মায়ের মুখের দিকে তাকানো যেতো না। দুশ্চিন্তায় কাবু কাহিল হয়ে গিয়েছিলো।
তোর বাবা একদিন ফিরে এলো। ৩০ শে নভেম্বর গভীর রাতে । খুব গোপনে। কোন কথা বলার সুযোগ নাই। কান্না কাটি করার সুযোগ নেই। কেউ জেনে যাবে তোর বাবা বাড়ি এসেছে। তাহলে বিপদ হয়ে যাবে।
আমরা কেউ বেশি কথা বলি নাই। শুধু জিজ্ঞাসা করেছি যুদ্ধের খবর। আমার বুকের ধন বলেছে সু খবর আছে। এখন বলতে পারবো না। আবার ফিরে এলে যুদ্ধের সব গল্প তোমাদের বলবো।
তোর বাবা ঐদিন রাতে বাড়ি ছিলো।তারপর দিন রাতে আবার গোপনে চলে যাবে। তোর দাদি পাটায় বেটে চিতই পিঠা বানানোর জন্য চালের গুড়ি করতে ছিলো, তোর মা মোরগ রান্না করতে ছিলো। তুই তখন তোর বাবার কোলে ছিলি।
সেদিন ডিসেম্বরের এক তারিখ। বেলা দুইটা আড়াইটার দিকে……
দাদু খানিকটা পানি খেয়ে নিলেন। দাদু কিছুটা কাঁপতে ছিলেন। দাদুর এখন বয়েস হয়েছে। দাদু আগের মতো আর কোন দু:খের খবর শরীরে নিতে পারেন না।
দাদুর চোখ রক্তিম বর্ণ হয়ে উঠেছে।চোখের কোণে সামান্য পানি।
দাদুকে চেয়ার থেকে নামিয়ে নিচে বসিয়ে দিলাম। দাদু হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলেন।বললেন,
বেলা আনুমানিক দুইটা আড়াইটার দিকে পাশের গাঁয়ের আজাহার উদ্দিন দল বল নিয়ে আমাদের বাড়ি এলো। আমি বাড়ির উঠোনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আজাহার উদ্দিন তোর বাবার নাম ধরে বলল, আমাদের কাছে খবর আছে মাজেদ বাড়ি এসেছে। ওকে ডেকে দিন। আমি কাচুমাচু করতেছিলাম।তোর বাবা ঘরে থেকে শুনে তোকে আমার কোলে দিয়ে বলল, বাবা ওদের দেখে রেখো।
বলে আজাহার উদ্দিনদের কাছে যাওয়া মাত্রই চাদরের নিচ থেকে পিস্তল বের করে দুই তিন রাউন্ড গুলি করে ওরা চলে গেলো।
তোর বাবা গগন বিদারি চিৎকার দিয়ে উঠোনের পর পড়ে গেল।পুরো উঠোন রক্তের বন্যা বয়ে গেল।
তোর মা মাজেদ কে ধরে আহাজারি করতে লাগলো।
গাঁয়ের লোক ভয়ে কেউ দেখতেও এলো না।তুই কোলে
ভয়ে কাঁদতে ছিলি। তোর মা তোর বাবার লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আর জ্ঞান ফিরে আসেনি। তোর দাদি সেই থেকে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটায় মাজেদ মাজেদ করে চিৎকার করে, হাসাহাসি করে।
দাদু আমাকে বুকের কাছে নেয়। জোরে আকঢ়ে ধরে।
ভাঁজ পড়া চোয়াল গড়িয়ে শত বছরের দু:খে জমা অশ্রুদানা চিকচিক করে ওঠে।