আবদুল ওহাব আজাদ
নাগেশ্বরী-কুঁড়িগ্রাম। সোহাগ পরিবহন ছেড়ে যেতে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি আছে। গাবতলী বাসটার্মিনালে সোহাগ পরিবহনের হেলপার ছেলেটি খুব জোর গলায় হেঁকে যাচ্ছে সোহাগ চেয়ারকোচ নাগেশ্বরী কুড়িগ্রাম। পরিবহনের যাত্রীূরা যে যার সিট বসে পড়েছে। উর্মির পাশের আসনটি এখনো খালি আছে। সেটি সি থ্রি। ড্রাইভার বারবার জোর করে হর্ণ বাজাচ্ছে। এ যেন এক্ষুনি গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার শেষ সংকেত। হঠাৎ গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পুর্ব মুহুর্তে হন্তদন্ত হয়ে গাড়িতে উঠলো এক সুদর্শন যুবক। সুপারভাইজারকে বলল, ‘ভাই, কাইন্ডলি আমার সি-ফোর সিটটি দেখিয়ে দিন। সুপারভাইজার হাত ইশারা করে উর্মির পাশের সিটটি দেখিয়ে দিল। যুবকটির নাম রুপক। রুপক উর্মির পাশে যেয়ে বলল, ‘ম্যাডাম আপনার সিট নং কি সি-থ্রী? উর্মি একটি সিনে ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিল। ম্যাগাজিন বন্ধ রেখে উর্মি বলল, আমার সিট নং কি আপনার জানার বড্ড প্রয়োজন? রুপক আমতা আমতা করে বলল, না মানে আমার সিট নং সি ফোর কিনা? উর্মি খানিকটা রুক্ষ মোজাজেই বলল, আপনার নং সি থ্রি হলে আপনি সি ফোরে বসুন, অন্যকে ডিস্টার্ব করার দরকার কি? রূপক কাঁচুমাচু করে বলল, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। রুপক আর কথা না বাড়িয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে তার সিটে বসে পড়ে। উর্মির দৃষ্টি ম্যাগাজিনের দিকে। রুপকও একটি গল্পের বই বের করে ব্যাগ থেকে। অনিচ্ছায় পাতা উল্টায় সে। লম্বা জার্নিতে রুপকের বই পড়া অতখানি পছন্দ নয়। তারপরও খুব মনোযোগ সহকারে পড়ার ভঙ্গি করে রুপক। গাড়ি চলছে দ্রুত বেগে। জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে গাড়ির ভেতর। কিছুক্ষন ধরে উর্মি বাইরের প্রকৃতি দেখছে। শাখে শাখে জড়াজড়ির দৃশ্যও দেখছে এক পলকে। শাল মেহগনি হিজল তমাল আর দেবদারুর সবুজ অবয়ব দেখছে সে মন ভরে। হঠাৎ করে মৃদু ঘুমে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে উর্মির। হাতের ম্যাগাজিনটাও পড়ে যায় পায়ের নিচে। মাথাটা ক্রমশ এলিয়ে পড়ে রুপকের কাঁধে। রুপক উর্মির চুলের ঘ্রাণ অনুভব করে। ডাকবে কি ডাকবে না ভেবে পায় না, রুপক। আস্তে আস্তে ঘুমে অচেতন উর্মির শরীরটা রুপকের দিকে বেশি ঝুঁকে এলে রুপক একটা হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম। এই যে ম্যাডাম। আপনি তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুম জড়িত কণ্ঠে উর্মি বলল, হ্যাঁ আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। রুপক এবার একটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এভাবে ঘুমোলে আপনার সবকিছু কিন্তু ছিনতাই হয়ে যাওয়ার শঙ্কা। উর্মির কণ্ঠে একটি চমৎকার সংলাপ শুনে অবাক না হয়ে পারলো না রূপক। উর্মি ঘুমে এখনো বেসামাল, তারপরও ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে উর্মি বলল, পাশে বিশ্বস্ত মানুষ থাকলে আমার কোনো কিছু খোয়া যাবে না। রূপক এক গাল হেসে বলল, কোনো মানুষকে এত সহজে বিশ্বস্ত ভাবা ঠিক নয় ম্যাডাম। উর্মি বলল, আসলে কাল রাতে একটু ঘুমোতে পারিনি। বাসায় অনেক সমস্যা ছিল। এখন একটু ঘুমাই ভাই! রুপক ভাবছে, এই তো একটু আগেও তাকে অপমানিত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি উর্মি। কেমন যেন সৌজন্যবোধও ভুলে গিয়েছিল সে। অথচ এক ঘন্টার ব্যবধানে সেই মানুষটি কত স্বাভাবিক, কত প্রাণবন্ত। রুপক বলল, বেশ তো, আপনি মন ভরে ঘুমান। আমি বরং জেগে সবকিছু পাহারা দেব। উর্মি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! রুপক নিজের গল্পের বই বাদ দিয়ে উর্মির সিনে ম্যাগাজিন তুলে পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ পর বিকট জোরে একটা শব্দ হলো, উর্মি চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ডাকাত-ডাকাত! রুপক উর্মির কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আরে ডাকাত না ম্যাডাম। গাড়ির চাকা বাস্ট হয়েছে। আপাতত গাড়ি আর চলছে না। চোখ খুলে অতি কষ্টে উর্মি বলল, তা হলে উপায়? রুপক বলল, চিন্তার কোন কারণ নেই। অল্পক্ষণের মধ্যে ওরা নতুন চাকা লাগিয়ে নেবে। ততক্ষণে চলুন আমরা নিচ থেকে একটু চা খেয়ে আসি। উর্মি বলল, না ভাই, আমি চা খাবো না, আপনি একাই খেয়ে আসুন। রুপক নাছোড় হয়ে বলল, আরে চলুন না, চা খেলে দেখবেন ফ্রেশ লাগবে, আর ঘুম তো দুচোখের ধারে-কাছেও আসতে পারবে না। উর্মি দুহাত জোড় করে বলল, প্লিজ ভাই, আপনি একাই খেয়ে আসুন, যান। রুপক একাকী গেল না। সে বলল, বরং গল্প করা যাক ম্যাডাম, আপনি তো নাগেশ্বরী নামবেন? জ্বি। আমি কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম আপনার কে আছে? আমার এক বন্ধু ওখানে চাকরি করে তা আপনাদের কি নাগেশ্বরীতেই বাসা। হ্যাঁ প্রোপার নাগেশ্বরী, সদর উপজেলাটার গায়। বাবা পুলিশে চাকরি করেন। পোস্টিং ঢাকায়। তাই বুঝি বাবার ওখানে গিয়েছিলেন? জ্বি। ভালোই হলো আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। অন্তত বাকি পথটুকু তো গল্পে গল্পে যাওয়া যাবে। মুহুর্তের মধ্যে হেলপার ছেলেটির গলা শোনা গেল। সে চেচিয়ে বলছে সবাই গাড়িতে উঠুন, গাড়ির চাকা ফিট করা হয়ে গেছে। সবাই যে যার সিটে যেয়ে বসলো। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। উর্মি বলল, আপনার বাড়ি কি গ্রেটার রংপুর? রুপক হেসে বলল, আরে না না, আমার বাড়ি গ্রেটার খুলনায়। বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা। আমার বাবাও কিছুদিন সাতক্ষীরা চাকরি করে এসেছেন। বাবা বলতেন, সাতক্ষীরার মানুষ খুব সুন্দর খুব অতিথি পরায়ণ। উর্মিকে রূপক সাতক্ষীরার মানুষের পক্ষ থেকে দাওয়াত দিয়ে বলল, আসুন না একবার সাতক্ষীরা। উর্মি মিষ্টি হেসে বলল, আপনি এমন করে দাওয়াত দিচ্ছেন মনে হচ্ছে আপনার জন্য একবার হলেও সাতক্ষীরায় যাব। রুপক বলল, বেশ তো, আপনার জন্য চাতক পাখির মতো পথ চেয়ে থাকবো। উর্মি আবারো হেসে বলল, আমি এমন কিছু নই যে আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে। জানি না আপনি কি ভাববেন তারপরও বলি, হঠাৎ করে নাগেশ্বরীর প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা জন্মেছে। নাগেশ্বরীর প্রতি। নাগেশ্বরীর মানুষের প্রতি না? রুপক হেসে বলল, কি যে বলেন। নাগেশ্বরী মূর্ত প্রতীক আমার পাশে বসা বলেই আমি ঐ জায়গা আর মানুষগুলোকে অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছি। এক মুহুর্তের ভালোবাসা একদম টেকে না জনাব। আমি কিন্তু জনাব নই রুপক। ভেরী সুইট নেম আমি উর্মি। সেটি তো আরো সুইট। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ভালোবাসা কিন্তু এক মুহুর্ত থেকেই সৃষ্টি হয়? যুগ যুগ অপেক্ষা করেও ভালোবাসা হয় না। কেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে না কি? কি যে বলেন সে সুযোগ আর পেলাম কোথায়? ইয়ে মানে কেউ যদি সুযোগ করে দেয় তাহলে আপনি দেখছি জোর করেই ভালোবাসা আদায় করতে চান; জোর করে কি ভালোবাসা আদায় করা যায় উর্মি। তা হয়ত যায় না ঠিকই কিন্তু কখন যে ভালোবাসা জন্ম নেয় তা কিন্তু কেউ বলতে পারে না। সত্যি আপনার কথায় যাদু আছে। চেহারায় রয়েছে বশীকরন মন্ত্র। তাই তো ক্রাশ নাগেশ্বরীর মানুষের প্রতি দুর্বলতা বেড়েই চলেছে। কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে শুনে এত দুর্বলতা বৃদ্ধি পাওয়া কি ঠিক? জেনে মুনে সম্পর্ক হয় না উর্মি। এসব ক্ষণিকের মোহ রুপক। আমাদের চলার গতি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই সম্পর্কের গতিপথও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই যদি হতো তাহলে কেউ কাউকে আর ভালোবাসতো না, কেউ কাউকেউ আর মনে রাখতো না উর্মি। উর্মি রুপকের পিঠে আলতো করে একটু চড় মেরে বলল। রূপক আস্তে, যাত্রীরা মাইন্ড করবে। রুপক স্বাভাবিক হলো। এখন আর কারো কথায় কোনো জড়তা নেই মনে হচ্ছে যেন কত দিনের চেনা ওরা। কিছুক্ষণ পর হো হো করে হেসে উঠল। রুপক। উর্মি বলল, হাসছেন যে? না, এমনি? না এমনি না। এমনি পাগলে ছাড়া হাসে না, নিশ্চয় কোনো কিছু ঘটেছে? আরে না কোনো কিছু ঘটেনি। উর্মি অভিমান করেই বলল, না বললে কিন্তু আমি আর একটি কথাও বলবো না রুপক। আসলে ব্যপারটা এ রকম। শুরুটা এমন ছিল যে মনে হচ্ছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দিয়েই শেষ নামবে। আসলে আমাকে কি সেরকম মনে হয়? প্রথমটা তেমন মনে হলেও এখন আর তা হয় না। এখন কি মনে হয়? এখন মনে হয় খুব শিগগির নাগেশ্বরীর সাথে সাতক্ষীরার সেতুবন্ধন হতে যাচ্ছে। রুপক আপনি এমনভাবে বলছেন মনে হচ্ছে যেন আপনি সবজান্তা। সবজান্তা না হলেও অন্তত এ বিষয়টি আমি উর্মির বুকের কাছে কান পেতে স্পষ্ট জানতে পেরেছি। রুপক এবার কিন্তু দুষ্টামি হয়ে যাচ্ছে। হোক র্দুষ্টামী। দুষ্ঠামি তো প্রেমের একটি অংশ। রুপক। যাওয়ার সময় এ ধরনের আপত্তিকর ডায়ালগ না ঝাড়লে কি হয় না? যাই বলুন না এখন আমার কি গান গাইতে ইচ্ছে করছে জানেন? কি? কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার। রুপক, যাওয়ার সময় আমাকে আর দুর্বল করে দিও না। আজকের এ স্মৃতি আমাকে ভীষণ কষ্ট দেবে, ভীষণ। উর্মির চোখ দুটো ভিজে উঠলো। কিছুক্ষণ উর্মি নীরব থাকলো। নীরবতাই বলে দিল, রুপকের সঙ্গে মুহুর্তগুলো তার ভালো কেটেছে। রুপককে তার মন্দ লাগেনি। ক্রমশ পথের গতি কমতে শুরু করলো। আর কয়েকটি বাক পার হলেই কুড়িগ্রাম। যেখানে নেমে যাবে রুপক, উর্মি যাবে সেখান থেকে আরো দীর্ঘ পথ, রুপক উর্মির নীরবতা ভাঙানোর চেষ্টা করলো। রুপক বলল, কি ভাবছ উর্মি? উর্মি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, রুপক, বিশ্বাস করো এখন আর আমার কিছু ভালো লাগছে না। তোমায় ছেড়ে যেতে আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ…।উর্মি তুমি এমন ভাব করছ যেন তোমার সঙ্গে আর আমার কোনো দিন দেখা হবে না। উর্মির গায়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো রুপক। রুপক বলল, উর্মি তোমার সঙ্গে আমার প্রায়ই মোবাইলে কথা হবে। এ নাও আমার কার্ড। তোমার নম্বরটি আমি আমার সেটে সেফ করে রাখি। তোমার নম্বর বল। উর্মি কনট্রাক্ট নম্বর বলল। রুপক বলল, সারাক্ষণ তোমায় এমন জ্বালাবো যে দেখবে তুমি এক সময় অস্থির হয়ে উঠবে। দিনে দিনে আমি বিরাগভাজন হয়ে উঠবো। উর্মি বলল, আমি জানি তুমি আমার মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছ, জানি তুমি একদিন ভুলে যাবে রুপক। ভুলতে চাইলে কি ভোলা যাবে উর্মি। রুপক। নিষ্ঠুর সময় কিছুক্ষণের মধ্যে তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। শুধু একবার বল আবার করবে আমাদের দেখা হবে? রুপক মৃদু কণ্ঠে গেয়ে উঠলো, আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো। উর্মি বলল, সত্যি আমাদের দেখা হবে? অবশ্যই দেখা হবে। তুমি আমার সঙ্গে নাগেশ্বরী যাবে রুপক? সেটা কি ভালো দেখাবে? ভালোমন্দ আমি ম্যানেজ করে নেব। তারপরও এবার থাক উর্মি। কিছুক্ষণের মধ্যে হেলপার ছেলেটি হেঁকে বলতে লাগলো। কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম রুপক কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিল। উর্মির চোখে জল। রুপক নিজ হাতে অশ্র“ বৃষ্টি মুছে দিয়ে বলল, আসি উর্মি! উর্মি কোনো কথা বলতে পারলো না, রুপক গাড়ি থেকে নামলো। উর্মি বাসের জানালা দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় সম্ভাষন জানালো রুপককে। রুপকও হাত নাড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে সোহাগ পরিবহন উর্মিদের নিয়ে নাগেশ্বরীর দিকে রওয়ানা হলো। এক সময় দুটি হাতের দৃশ্য দূরত্বের ব্যবধানে হারিয়ে গেল।