লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এসেছে এই বিজয়, এই ঘটনা থেকে পাকিস্তান আর তার মিত্রশক্তি শিক্ষা নেবে বলে মনে করি, সারা বিশ্ব জানতো দেশে পাকিস্তানের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল, তাই বাংলাদেশের শত্রুদের আমি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে, অনেক অত্যাচার সহ্য করে চোখের জলে চিনতে পেরেছে কারা দেশের প্রকৃত শত্রু আর কারা সত্যিকারের মিত্র। ১৬ ডিসেম্বর মুজিব নগরের এক সভায় এ কথা বলেন বাংলাদেশের প্রবাসী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন। পাকিস্তানী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর নির্দেশে ভোর পাঁচটা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যুদ্ধবিরতি শুরু করে।
সকাল নয়টা নাগাদ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডার মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিংয়ের বার্তা নিয়ে তার এডিসি কর্ণেল হিতেশ মেহতা এবং দুই নম্বর প্যারা ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডার ক্যাপ্টেন নির্ভয় শর্মা সাদা পতাকা উড়িয়ে মীরপুরে জেনারেল নিয়াজীর হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা দেয়। সেই বার্তায় ইংরাজিতে লেখা ছিল আমরা আপনাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছি, আপনারা আত্মসমর্পণ অথবা ধ্বংস যে কোনো একটা বেছে নিন, আপনাদের খেলা শেষ আমরা কথা দিচ্ছি আপনি আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী ব্যবহার করবো, আমি আশ্বস্ত করছি আপনার জীবনের ভয় নেই, ইতি জেনারেল জি সি নাগরা।
দুপুর ১টার মধ্যে কলকাতা থেকে ঢাকায় উড়ে আসেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং অরোরা,চীফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জে আর জেকব। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে চলে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক।যৌথবাহিনীর পক্ষে ছিলেন মেজর জেনারেল জে আর জেকব, মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা, কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী,লে:জেনারেল ফরমান আলী এবং লে:জেনারেল মহম্মদ জামশেদ। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণের দলিলে সই করবেন জেনারেল নিয়াজী এবং জগজিত সিং অরোরা।
অনেক ঘটনার শেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিকেল ৪টের সময় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ময়দানে আসেন জেনারেল নিয়াজী, বিকেল ৪ টে ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল নিয়াজী, আত্মসমর্পণের দলিলে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার রিয়ার – এডমিরাল মহম্মদ শরীফ, বিমানবাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল প্যাট্রিক ডেসমন্ড কালাঘানও সাক্ষর করেন। এই অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ সরকারের হয়ে এ কে খোন্দকার,সাক্ষী হিসেবে ভারতের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ভারতের ৪র্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সওগত সিং, বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে এয়ার মার্শাল হরিচাঁদ দেওয়ান এবং পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান জেনারেল জেকব।
এই সাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করলো জনমানসের চরম আকাঙ্খার আর একটা স্বাধীন দেশ লাল সবুজের বাংলাদেশ। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করা মাত্র ঢাকায় উল্লাসে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। এখানে সেখানে মিছিল আর মিছিল, যে যাকে সামনে পাচ্ছে জড়িয়ে ধরছে,জয়োল্লাসে ফেটে পড়ছে ঢাকা সহ সারা বাংলাদেশ।মুক্তির আনন্দের জয়োৎসবে আপ্লুত হয়ে কেউ কেউ কাঁদছে কেউ হাসছে, খোলা ট্রাকে, ভ্যানে, জীপে করে দোর্দন্ড প্রতাপে সারা শহর, সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। তাদের হাত ধরে চুমু খাচ্ছে সাধারণ মানুষ, কেউ কেউ ওদের ট্রাকে জীপে উঠে পড়ছে, গান বাজছে লাউড স্পীকারে লড়াইয়ে গান, এভাবে দিনের আলোয় রাতে উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে জনতা বিজয় উল্লাস উৎসব পালন করেছে সারাদেশ জুড়ে, হাতে সেই দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতীক লাল সবুজ পতাকা আর মুখে স্লোগানে কেঁপে উঠছে আকাশ বাতাস জয় বাংলা জয়,,, বাংলা…