-মুন্নী, এখনো কাজ শেষ হয়নি ?
– শেষ আপা, এই ২টা কাপড় ধুইলেই শেষ।
-ঠিক আছে, তাহলে এটা শেষ করে আমার রুমে আসবে।
-আচ্ছা আপা।
মাইমুনার বয়স ১৩, আপাজান আদর করে তাকে
মুন্নি ডাকে। ৪ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুন্নি এই বাড়িতে এসেছে। সে সব কাজেই পটু । না, না, ভুল বলে ফেললাম। ঢাকা শহরের অন্যান্য বুয়াদের মতো সে চুরিতে অভিজ্ঞ নয়। এই নিয়ে তাকে প্রতিরাতে বাপজানের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়। প্রায় সন্ধ্যায় মাতাল হয়ে আসা বাপজানের হাতে সে মার ও খায়। সংসার চলে মুন্নীর ভরসায়। দুটো মানুষের পেট ভরার পর নেশা করার টাকাও থাকে। মুন্নীর বাপজান তো সবসময় এমন ছিল না। একসময় ভ্যানগাড়ি চালাতো, যখন তার মা তাদের সাথে ছিল। মা-র কথা মুন্নী ভাবতে চায় না। শুধু এই একটা মানুষকেই মুন্নী বড় ঘৃণা করে।
গায়ের কাপড় ঠিক করে মুন্নী আপার রুমের কাছে আসে। সে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
– এখানে বসো।
মুন্নী, তোমার কী পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করে ?
– না, আপা
– কেন?
– এহন কাজকাম করতেই ভাল্লাগে, আপা।
– তোমার বয়সী মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তাদের দেখে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না?
-না,আপা।
-আচ্ছা এখন যাও। কাল আবার সময়মতো চলে আসবে।
মুন্নী জানে, সীমা আপা ভালো মানুষ, সে সারাজীবন তার বাড়িতেই কাজ করতে চায়। কয়েকমাসেই আপার উপর তার মায়া পরে গেছে। সীমা আপা মাঝে মাঝে তাকে সাথে নিয়ে নাস্তা করে। তখন যে তার কী আনন্দ লাগে। এত আনন্দ সে সহ্য করতে পারে না। তখন ইচ্ছে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। সে আপার সাথে গল্পও করে,তার বাবার গল্প, তার ছোটোবেলার গল্প, আগের বাড়িগুলোতে তার কাজের গল্প। মুন্নী কখনো তার মাকে নিয়ে কিছু বলেনি, সীমা আপাও জিজ্ঞেস করেনি।
-কই যাও টুনটুনি?
মুন্নী বিরক্তমুখে হেঁটেই চলেছে,একবারও তাকায়নি,গলার স্বরটা তার পরিচিত।
-আরে টুনটুনি, শুইনা যাও
বলেই লোকটা মুন্নীর হাত ধরে আটকায়।
– আপনে আমার হাত ধরছেন কান? হাত ছাড়েন, ছাড়েন কইতাছি!
-আরে চ্যাতো ক্যান, নেও কলা খাও
-আপনের কলা আপনেই খান।
বলেই মুন্নী আবার হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষন আগে যে লোকটা হাত ধরেছিল, তার নাম সৈকত আলী, বয়স ৫০-এর কিছু বেশি হবে, সমাজের চোখে সে অত্যন্ত ভদ্র ও ভালো মানুষ। সবাই জানে আলী সাহেব মুন্নীকে মেয়ের চোখে দেখেন।কিন্তু বদ-টা কখনোই মুন্নীর দিকে ভালো নজরে তাকায়নি। মুন্নী সেটা বুঝতে পারে। তাকে পছন্দ না করার আরেকটা কারণ, তার কারণেই মুন্নীদের সুন্দর, গোছালো সংসারটা ভেঙেছে। সেদিন রাতে, লঞ্চে তার মার হাত ধরা সে এই লোকটাকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। স্বর্ণা খালার বাসায় সে দুপুরে রান্না করে দিয়ে আসে। খালা সারাক্ষনই তার কাজে ভুল ধরে। তাদের বাড়িটা অনেক বড়। সবসময় লোকজন দিয়ে ভর্তি থাকে। এত এত রান্না করে যে হাঁপিয়ে ওঠে। একদিন দুপুরে ক্লান্ত হয়ে, খালাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি আসবে,এমন সময় হঠাৎ কেউ তার মুখ চেপে ধরে।প্রথমটায় মুন্নী ভয় পায়। তারপর তাকে টানতে টানতে গুদামঘরে নিয়ে যায়। মুন্নী মানুষ টাকে দেখতে পেয়ে চমকায়। এ-তো ছোটোসাহেব! মুন্নী চিৎকার করে সাহায্য চাইছে, কিন্তু তা শোনা যাবে না। কারণ ততক্ষনে তার হাত আর মুখ বাঁধা হয়ে গেছে। মুন্নী শ্বাস নিতে পারছে না। ছোটোসাহেব মুন্নীর পা-গুলোকেও আটকে রেখেছে।তারপর, তারপর, না, আর কিছু মনে করতে চায় না মুন্নী। সেদিনের কথা সে কাউকে বলতে পারেনি। নিজের জীবনটুকু ভিক্ষা পেয়েছে, এইবা কম কী ? সীমা আপার বাসায় যখন কাজ শুরু করে, একবার ভেবেছিল আপাকে বলে দেখবে, কিন্তু আপা জানতে পারলে পুলিশেও খবর দিতে পারে। তা হতে দেওয়া যায় না, পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে যাবে। আজ স্বর্ণা খালার বান্ধবীরা এসেছেন। দুপুরে খাবে। বড়লোকদের সব খাবার রান্না করা হবে। সেই সব খাবারই মুন্নী রাঁধতে জানে, তবে সেগুলোর স্বাদ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সেও মুখ ফুটে কখনো খেতে চায়নি। মুন্নী তার পরিচিত বস্তিতে ফিরে এসেছে। তার এখন নিজের জন্য রাঁধতে হবে।দুপুরে সে একাই খায়। ৪-৫ বছর আগে, তার মা সঙ্গে করে ছোটো ভাইটাকেও নিয়ে গেছে, নাহয় আজ দুপুরে তারা একসাথে বসে খেতে পারত। হয়তো ভাইকে নিজের হাতে খাইয়ে দিত। ভাইটাকে নিয়ে তার খুব চিন্তা হয়।মা তো আর বেঁচে নেই, যার সঙ্গে মা পালিয়েছিল, সেও ফিরে এসেছে। ছেলেটা কী এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? দুবেলা খেতে পায় তো? মুন্নী আর রাঁধতে বসেনি। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। এতক্ষণ কমই ছিল, এখন বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যে তাদের খুপড়ীর মতো ঘরটাতে পানি উঠবে। তখনতো তাকেই সব পরিষ্কার করতে হবে। মুন্নী একটু দূরে পা গুটিয়ে বসে আছে। এখন আর কিছুতে মুন্নীর মন বসে না। তারও তো ইচ্ছে হতে পারে-ভালো বাড়িতে থাকার, ভালো কাপড় পড়ার, ভালো খাবার খাওয়ার, ব্যাগভর্তি বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার। তার মা থাকলে তার ইচ্ছে গুলো কি পূরণ হতো?এর উত্তর মুন্নী জানে না। মা কেমন ছিল, তার মনে নেই। নাহ্, আর মা-র কথা ভাবলে চলবে না। যার জন্য তার এই অবস্থা, মুন্নী তাকে মন থেকে ঘৃণা করতে চায়। মুন্নী এবার উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজা-জানালা বন্ধ করতে হবে। ঘরে পানি আসতে শুরু করেছে।