• আজ- শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন

ভাগ্য

গোলাপ মাহমুদ সৌরভ / ৩৬৩ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

add 1
  • গোলাপ মাহমুদ সৌরভ

সজল গরীব ঘরের ছেলে। বাবার সাথে কাজ করে অতন্ত্য কষ্ট করে লেখাপড়া করে। সজল একজন মেধাবী ছাত্র, খুব সহজ সরল নম্র ভদ্র প্রকৃতির ছেলে। তার বাবা একজন খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষ। কখনো মানুষের বাড়িতে কাজ করে আবার যখন ফসলের সিজন আসে মানুষের জমি বর্গা চাষী হয়ে কাজ। জমিতে যা ফসল ফলে তা দুই ভাগ করে একভাগ নিজে রাখে আরেক ভাগ জমির মালিককে বুঝিয়ে দেয়। আবার যখন বর্ষাকাল আসে তখন দিনের বেলায় তিতাস নদীতে যাত্রী পাড়াপাড় করে রাত্রি হলে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বেলে জাল ফেলে মাছ ধরে এভাবেই সজলের বাবা অতি কষ্ট করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। সারাদিন রাত্রি যেন কষ্টের গ্লাণি টানেন তারপরও স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করেন। সজলের মা গৃহিণী। সবাই ভালো কাপড়চোপড় পড়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায় আর সজল পলিথিনে করে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায় এতে সজলের মনে কোন দুঃখ কিংবা কষ্ট অনুভব হয়না কারণ সজল জানে, তার বাবা একজন গরীব খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষ তার পক্ষে এতো কিছু কিনা সম্ভব না। কখনো সজল ভালো কিছু ছেয়ে বাবার কাছে আবদার ও করেনা। সজল অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকে সবসময় মুখে যেন একটা হাসি লেগেই থাকে তার মনে দুঃখ আছে কিনা তা বুঝা বড়ই কঠিন। সজল হাসির ছলেই দুঃখ লুকিয়ে রাখে। যখন সকাল হয় তখন দিনের আলোতে উঠোনে পাটের ছালা বিছিয়ে পড়তে বসে। যখন স্কুলের সময় হয় তখন নিজে নিজে তৈরি হয়, রাতের খাবার শেষে যে অল্প ভাত থাকে তা সজলের মা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখে যাতে করে নষ্ট না হয় যা গ্রাম্য ভাষায় পানিভাত বলে। সকাল বেলা শান্ত ছেলের মতো পানি ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যায়। সজল গরীব বলে ভালো ঘরের ছেলেরা তার সাথে তেমন বসতে চায়না। ক্লাসের কিছু ছেলেরা সজলের শরীর থেকে ঘামের দূর গন্ধ আসে বলে অপমান করে, তাতে সজল মোটেও কান দেয় না সবসময় ক্লাসে প্রথম বেঞ্চে বসে আর মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা গুলো শুনে ক্লাসেই অনেকটা পড়া আয়ত্ত করে ফেলে। সজল কখনো স্যারের কাছে কোন অভিযোগ ও করে না অন্য ছাত্ররা এতো কিছু বলার পরেও। একদিন করিম স্যার দূর থেকে লক্ষ্য করে দেখছেন ক্লাসের অন্য ছাত্ররা সজল কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে এবং অনেক হাসাহাসি করছে সজল অসহায় প্রাণীর মতো নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। স্যার ক্লাসে এসে দেখলেন সজলের মনটা কেমন আনমনা হয়ে আছে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন সজল কি হয়েছে তোমার? সজল যেন অশ্রু সিক্ত ভেজা চোখে বললো কিছু হয়নি স্যার। কিছু হয়নি তাহলে তোমার চোখে পানি কেন? এটা পানি নয় স্যার এটা আমার ভাগ্যের পরিহাস সকলের চোখে অবহেলার ফল। কেন কেউ কিছু বলেছে তোমায়? পাশে বসা নিপন উঠে দাঁড়াল ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলতে লাগলো আচ্ছা স্যার, গরীব হওয়ার পিছনে কি কারো হাত আছে কিংবা গরীব হওয়া কোন পাপ। না, কেউ ইচ্ছে করে গরীব হয়না আবার কারো হাতও নাই কারণ ধনী গরীব সবই আল্লাহর ইচ্ছা তিনি কাউকে গরীব আবার কাউকে ধনী বানিয়েছেন। আর ধনী গরীব আছে বলেই মানুষের মাঝে এতো ভেদাভেদ আর সবাই যদি সমান হতো তাহলে কেউ কাউকে সম্মান করতো না। ঠিক আছে স্যার আপনার কথা, আর এজন্যই কিছু মানুষ কারো দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে যা খুশি তা বলেতে পারে। যেমন প্রতিদিনই ওরা সজল কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে খুব অপমান করে এটা কেন স্যার, ক্লাসে কোন ধনী গরীব নাই, এখানে জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি হিংসা বিদ্বেষ শিখতে নয়, অহংকার বোধ নিয়ে কেউ শিক্ষা অর্জন করতে পারেনা, কেউ সভ্য জাতি হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা কারণ অহংকার হলো পতনের মূল। মনে রেখো শিক্ষার্থী বন্ধুগন আজ তোমরা যারা সজল কে অহংকার করে অবহেলার চোখে দেখছো এমনও হতে পারে এই সজলই একদিন অনেক সম্মানিত ব্যক্তি হতে পারে তোমরা পড়াশোনা থেকে ছিটকে যেতে পারো কার ভাগ্যে কি আছে কেউ বলতে পারিনা তাছাড়া সজল গরীব তাই অবহেলিত কিন্তু মেধাবী যা এ বিদ্যালয়ের জন্য গৌরবের এই সজলই একদিন আমাদের স্কুলের সম্মান বয়ে আনতে পারে। তোমরা অহংকারী হতে পেরেছো কিন্তু মেধাবী হতে পারনি। সুতরাং ছাত্রদের মাঝে ধনী গরীব ভেদাভেদ থাকতে নেই এখানে জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতা চলে যা দিয়ে একজন আদর্শ সমাজ দেশ এবং রাষ্ট্র গড়া যায়। করীম স্যার বললেন, নিপন তুমি খুব সুন্দর বলেছো তোমার কথা গুলো খুবই দামী এবং বাস্তবমুখী তাই কেউ কাউকে অবহেলার চোখে দেখো না ভেদাভেদ ভুলে জ্ঞান অর্জনে মনোযোগ দাও কারণ তোমরা একদিন বড় হবে ভালো মানুষ হবে এবং দেশপ্রেমিক হবে আদর্শ শিক্ষক হয়ে অন্যের মাঝে নিজের শিক্ষা এবং জ্ঞান প্রচার করে আদর্শ মানুষ হতে পারবে। আজকের পর থেকে ক্লাসে কেউ যেন সজল কে নিয়ে বাজে মন্তব্য না করো ভালো বন্ধু পাশে দাঁড়াও সজল কে শিক্ষিত হতে সহযোগিতা করো তাহলে তোমরা ও একদিন আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। মনে রেখো, তোমরা দেশ সমাজের ভবিষ্যৎ। আজকে শিক্ষার জন্য এসেছো কাল সেবার জন্য বেরিয়ে যাবে। করীম স্যারের কথা শুনে অহংকারী ছাত্রদের মাঝে বিনয়ী আচরণ করে বললো, স্যার আসলে আমরা বুঝতে পারিনি আপনার কথা এবং বন্ধু নিপনের কথা শুনে আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি, ক্লাসে কোন ধনী গরীব থাকতে নেই সবাই ভালো বন্ধু হয়ে থাকা জরুরি আজ থেকে আমরা সজলের ভালো বন্ধু হয়ে পাশে থাকবো, সজল যে একজন মনের দিক থেকে অনেক বড় এবং মেধাবী তা বুঝতে পেরেছি। স্যার আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন এবং সজল কে বলুন আমাদের কে ক্ষমা করে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে এবং বন্ধু ভাবে। ঠিক আছে তোমরা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছো এজন্য তোমাদের কে ধন্যবাদ ও সকলের জন্য শুভকামনা রইল। আজ তাহলে এপর্যন্তই বলে স্যার বেরিয়ে গেলেন। স্যার যাওয়ার পরপরই সবাই সজলের সাথে কোলাকুলি করে সব ভুলে গিয়ে ভালো বন্ধু হওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো এবং যে যার মতো করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো।

সজল বাড়িতে গিয়ে মাকে বললো, মা বাবার খাবার পাঠানো হয়েছে। না, কে নিয়ে যাবে বল,তুই ছাড়া কে আছে নিয়ে যাওয়ার মতো। ঠিক আছে মা,তুমি ভাত তরকারি বলে দিয়ে একটা গামছা দিয়ে বেঁধে দাও আমি নিয়ে যাচ্ছি। মা তারাহুরো করে ভাত তরকারি গামছায় বেঁধে দিলো সাথে এক মগ পানি। সজল খাবার এবং সাথে একটা বই নিয়ে জমিতে রওনা দিলো। সজল দূর থেকে দেখলো বাবা কাদামাখা শরীর নিয়ে ক্ষেতের লাইলে বসে আছে একপেট ক্ষুধা নিয়ে আর তাকিয়ে দেখছে সজল কখন আসবে। কিছুক্ষণ পর সজল তার বাবার কাছে পৌঁছাল। সজল এসেছিস বাবা আমি কখন থেকে তর অপেক্ষা করছি, জানিস বাজান আজ এতোটাই পেটে ক্ষুদার্ত কাজ করতে পারছিলাম না তাই কাজকর্ম বাদ দিয়ে লাইলে বসে আছি তুই আসবি বলে। সরি,বাবা আজ অনেক দেরি হয়ে গেলো, এই নাও বাবা তারাতাড়ি খেয়ে নাও। দে বাবা আর পারছিনা। বাবাকে খাবার দিয়ে সজল বই নিয়ে বসে পড়লো। বাবা হাতটা কোনরকম ধুইয়ে খাওয়া শুরু করলো। কয়েক লোকমা খেয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো তুই খাইসত বাজান? না বাবা, তুমি খাও আমি বাড়িতে গিয়ে খাইমু। বাজান তোর খুব কষ্ট হয় তাইনা রে? না বাবা কষ্ট হবে কেন আমার কাছে ভালোই লাগে তাছাড়া আমি কিছুই মনে করিনা কারণ আমরা গরীব কোন রকম আমাদের সংসার চলে তাও আবার তোমার একা কামাই দিয়ে সজল বললো। এদিকে আয় বাজান আমার লগে কয়ডা খাইয়া লয়। না তুমি খাও বাবা। বাবা হাতে লোকমা নিয়ে সজলের মুখে তুলে দিলো। আচ্ছা বাজান তুই ছোট মানুষ তরে দিয়ে আমি কতো কাজকর্ম করাই তারপরও তুই লেখাপড়া করস জানিস বাবা মাঝে মাঝে আমার কাছে আমারে অপরাধী মনে হয়। কেন বাবা এমন কথা বলছো কেন? আল্লাহ আমাদের কে এতোটাই গরীব বানাইছে ঠিক মতো তিন বেলা খাবার খাইতে পারিনা তকে ভালো কাপড়চোপড় কিনে দিতে পারিনা ভালো খাওয়াতে পারিনা এই দুপুর বেলা পোড়া মরিচ কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাইলাম। থাক বাবা তুমি এসব বলো না এটাই আমাদের ভাগ্য, আল্লাহ আমাদের রিজিকে যা রাখছে তাই খাই, না খেয়েত নাই তাতেই আলহামদুলিল্লাহ, তুমি দেখো বাবা একদিন আমাদের এমন পরিস্থিতি থাকবেনা আমি যেদিন পড়াশোনা করে অনেক বড়ো হবো সেদিন আমাদের সব বদলে যাবে। সত্যি সজল তোর মতো সন্তানের বাবা হতে পেরে আমি আনন্দিত এবং গর্ববোধ করি, আমার বিশ্বাস তুই একদিন অনেক বড়ো হবি, সেদিন আমাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। সত্যিই সমাজের হতদরিদ্র মানুষ গুলোর মনে অনেক স্বপ্ন থাকে একদিন তারাও দারিদ্র্য মুক্ত পরিবার হবে এবং সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। সজল সময় কখনো অপচয় করে না সবসময় কাজের সময় কাজ আর পড়ার সময় পড়ে সময় পার করে। বাবা ভাত খাচ্ছে এদিকে সজল বই পড়ছে। সজল লেখা পড়ার প্রতি খুবই মনোযোগী, পাড়ার আঁট দশটা ছেলের মতো পাড়ায় পাড়া ঘুরে আর খেলাধুলা করে না কখনো কারু সাথে ঝগড়াঝাটিও করে না, নম্র, ভদ্র খুবই লাজুক প্রকৃতির ছেলে সজল। সব সময় বড়দের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলে। এতোক্ষণে বাবার খাওয়া শেষ হলো আর সজল মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। সজল বললো বাবা তুমি খেয়েছো এবার একটু জিরিয়ে নাও তারপর কাজ করো। সজল তুই এতো ভালো কেনরে বাবা, তুই দেখি সবসময় আমার প্রতি খেয়াল রাখস তোর মতো এমন সন্তান যাদের ঘরে আছে সেই ছেলের বাবা-মা কি কোনদিন কষ্টে থাকতে পারে, সজলের বাবা বললো। বাবা তুমি একটু জিরিয়ে নাও আমি বই রেখে ক্ষেতে করছি। খাওয়ার পরে সবার দেহে একটু ক্লান্তি আসে। সজলের বাবা ক্ষেতের লাইলে লম্বা হয়ে শুইয়ে পড়লো,ক্লান্ত দেহে কখন ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারেনি। এদিকে সজল আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ সজল তাকিয়ে দেখলো তার বাবা খুব আরামে ঘুমাচ্ছে তাই সজলের মনে খুবই মায়া হলো বাবা ডাক না দিয়ে নিজেই কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জেমের আযান শুনা যাচ্ছে। হঠাৎ করে আযানের শব্দ কানে এসে লাগলো তাই ঘুমটাও ভেঙে গেলো। বাবা তোমার ঘুম ভেঙেছে সজল বললো? সজল আমি একটু চোখ বুঝেতেই কখন ঘুমিয়ে গেছি বলতে পারিনা তুই আমাকে ডাক দিলি না কেন। আমি দেখছি তুমি খুব আরামে ঘুমাচ্ছো তাই তোমাকে ডাক দেইনি, চলো আজকে আর কাজ করতে হবেনা আমরা বাড়িতে চলে যাই। চল বাবা আজকে আর ভালো লাগতাছে না বাড়িতে চলে যাই সজলের বাবা বললো। দুজনেই বাড়িতে চলে গেলো।

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Sundarban IT