• আজ- সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৭ পূর্বাহ্ন

পার্সেল

রাশিদুল ইসলাম / ২৭৯ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : শনিবার, ২৪ জুন, ২০২৩

add 1
  • রাশিদুল ইসলাম

রকেট কে দেখে মনে হবে সেই যেন পোস্ট মাস্টার বাবুটি কিংবা ধরুন সুকান্তের কবিতায় হারিকেন হাতে দূরন্ত রানার। রকেট কে রকেট ভেবে অনেকই গুলিয়ে নিতে পারে। সেই অকর্ম টি করার আগেই বলি ওর নাম শুধুমাত্র জ্ঞাতসারেই রওনক। তা বাদে রকেট নামের নামোপমার সাথে তার সকল কলাকুশলীর অন্তমিল। বাপদাদা যুুগের ডাকঘর আধুনিক পার্সেল অফিসে রুপাচ্ছাদিত হয়েছে বলাবাহুল্য। রওনক সে-রকম একটা অফিসের আবগারি। গুলশানের আসেপাশে যেসব বাসায় পার্সেল আনা-নেওয়া হয় সেই তদবির গুলো রওনকের কাঁধেই সোপর্দ করা হয়। তার ফাঁকিবাজ কলিগদের মত মেন্টালিটি গ্রোআপ হয় নি গেল পাঁচ বছরেও। গৃহকতৃী এ নিয়ে কথা শোনাতে কম যায় না। অভাবের দলিলে সংসারের জেরা বইতে চেনা শহরের অলি-গলি গেট-দারোয়ান আর অভিনব কলিংবেলের শব্দে সে গৃহের জঞ্জালকণা রুমালে ঘাম মোছার মত ধুয়ে ফেলতে চায়। সকালের নাস্তা বাড়িতে করার চল কবেই চুকেছে। স্ত্রীর বকুনির ঝালে তা যে মুখে তোলাই ভার। তার ছেলেটা জেগেছে।
— ছেলেটা জাগল নাকি দেখো তো।
বোতাম গুলো ছিদ্রের ফাঁকে গাঁথতে গাঁথতে যেই বলেছে রওনক ওমনি হিংস্র প্রিয়তমা এসে ঠমকচালে ঝগড়ার তাল ঠিক রেখে উচ্চাঙ্গ অশ্রাব্য গীতি একনাগাড়ে রেওয়াজ করে গেছে। বাধ্য হয়ে রওনক ছেলেটার উঁ উঁ ধ্বনিকে উপেক্ষা করে দিনকার মত বউ বাচ্চার গাট্টি বোচকা একটা মৃদু তবু রাগী ‘ধুরররর জেবনডা ঝালাপালা কইরাইলি’ সংলাপে কুঠুরি পেরিয়ে শহরের মঞ্চে সুখের যাত্রাভিনয় করে অফিস পথে হাঁটে । কাছেই বৃন্দাবনের সেলুনে চুলের এলোমেলো ঝাঁক গুলো সরু নদীটির মত চিরুনির শাসনে ঠিক করে নেয়। তার ভেতরে গুপ্ত থাকা আশৈশব চঞ্চলতা, দারুণ ঝিকঝিক গতিময়তা, অশ্রান্ত, অক্লেশ সরলতা জেগে ওঠে তখন। বাড়ির বাইরে আসলেই তার হালকা লাগে।
পার্সেল অফিসের দুটি দরজা। পাশাপাশি এক ঘরে গ্রাহকের মালামাল সামগ্রী আর এক পাশেে স্লিপিং রুম। সেখানেই টেবিলের উপর কাগজের দস্তখৎ নিয়ে বসে আছেন নবীনদা। নবীনদা অফিসের বস। চেহারায় তিরিক্ষি ভাব থাকলেও বেশ সরল-শান্ত। যখন কথা বলে মনে হয় কথা গুলো পোনা মাছের মত খলবল করে কন্ঠ নি:সৃত হয়ে বের হচ্ছে। রওনক ওরফে রকেট কাছে গিয়ে দাড়াতেই খসখসে কলমের আচড়ে একটা আড়ং রশীদ ধরিয়ে দিয়ে আরেকটায় মনোযোগ দিলেন। চোখ নামিয়ে বল্লেন,
– মালামাল খুব একটা দেওয়া নেওয়া হচ্ছে না রে। এই মাস ছোকরা গুলো খাটুক। সামনে মাসে কিছু ছাঁটাই হয়ে যাবে মনে হয়।
রওনক নিশ্চুপে ছুটল পার্সেল হাতে পথে। ঠিকানা অনুযায়ী হাঁটা পথে মিনিট বিশেক লাগার কথা। তবু তার ভেতরে অদ্ভুত তাল। সামনের মাসে কি তাকে ছাঁটাই করা হবে? সে ফের ভাবে, নাহ সার্ভিস তো খারাপ দিয়ে আসছে না। তবুও সুক্ষ্ম একটা চিন্তা তাকে খোঁচায়। সংসারের অশান্তি নিয়ে সে কোনোমতে বেঁচে আছে চাকরি গেলে তা যে চরমে পৌঁছাবে। নাকি ব্যাকআপ হিসেবে অন্য কিছু খুঁজবে? কপালের ঘামটা একবার সে মুছে নেয়। গুলশান ১ এ দাঁড়িয়ে রওনক। রশীদের ঠিকানা অনুযায়ী সে চলে এসেছে। চোখ কপালে উঠার মত মস্ত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তার নিজের অবস্থান নিয়ে হাসি পায়। কারুকাজ করা গেট পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় পৌঁছে যায়। কলিংবেল টিপতে হবে এবার। কলিংবেলটা রওনকের কাছে ভাগ্যের উপমা মনে হয়। কত জায়গায় সে কত তদবির নিয়ে গেছে কিন্তু কখনো তার মনে এতটুকু কালিমা উঁকি দেয়নি। কখনো তার মনে হয় নি পার্সেল টা খুলে পরখ করে। দরজা খুলে যে বের হলো তার আঙ্গিক বিবরণ এইটুকু যে সে একজন উঠতি বয়সী মেয়ে। রশীদে সিগনেচার করে পেঁচানো মুঠি বদ্ধ কয়খানা নোট সে রওনকের হাতে গুঁজে দিয়ে তড়িঘড়ি ভেতরে চলে গেল। মেয়েটির মুখের অন্ধকার রওনকের চিরচেনা চিত্র। তার দৃষ্টিপটে এই বিমর্ষ রুপ অসংখ্য বার ধরা দিয়েছে। রওনক টাকা গুলো দু’বার গোনে দাড়িয়েই। সর্বমোট ১৫০টাকার নেতানো জলজ নোট গুলো সে মুষ্টি বদ্ধ করে আর ঠিক তখনি আগের মত তড়িঘড়ি করে ভেজানো দরজা ফাঁক হয়ে যায়। মেয়েটি অসম্ভব অস্থীর ভাবে নড়ছে। তার কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বাদামি শপিং ব্যাগ ঢুলছে।
— ভাইয়া একটু উপকার করেন না প্লিজ। এই ব্যাগটা পৌঁছে দিবেন দয়া করে। ব্যাগের গায়ে ঠিকানা লেখা আছে।
মেয়েটি হাত আগালো তবে রওনক নিশ্চল। সে অফিশিয়াল কাজ ছাড়া ব্যাক্তিগত কোনো আবদার সচারাচর রাখে না। মেয়েটি আর্জি নিয়ে তাকালো আর তখনি বেদনার একটা দেশলাই যেন নি:শব্দে জ্বলে উঠলো মেয়েটির অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখে। পোটলাটা তার নিতেই হলো।
— ব্যাগের ভেতরে আরও দুইশ টাকা আছে। ভাড়া দিয়ে যা বাচে আপনার।
— কি আছে এতে?
মেয়েটি তাকালো তবে এবারে আবার সেই অবাধ্য অন্ধকার ভেসে উঠলো মুখে আর রওনক ” পৌঁছে দেবো ” বলে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। মেয়েটির মুখের অন্ধকার রওনকের আর দেখা হবে না। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে জীবনের অতল কুটিরে। প্রতিটি ধাপে তার মৃতপ্রায় ইচ্ছাগুলো ঝরে পড়তে লাগলো শীতের পাতাদের মত।
ব্যাগের গায়ে কাঁপা ছোট-বড় অক্ষরে যে ঠিকানা লেখা সেখানে হেঁটে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। রওনকের পেট টনটনায়। মেইন রোডে এসেই সে বাস ধরল। এই বাস বেগুনবাড়ি হয়ে যাবে। বাসে উঠেই তার ভ্রান্ত ধারণা কেটে গেল যে পাবলিক বাসে নাকি যা তা অবস্থা। ভাড়া নেবার সময় দেখা গেল মেশিনের বোতাম টিপে স্লিপ বের করে দিল কালেক্টর লোকটি। জানলার ধারে চেপে বসলে শহুরে হাওয়ায় তার কেমন একটা ভাসা ভাসা ছবি চোখে পড়ে গেল। ঠিক চোখে নয়—মনে পড়ল। নাইমা কে নিয়ে তার স্বতেজ স্মৃতি গুলো শুকনো হয়ে গেছে এতদিনে। সংসারে এসে নাইমা প্রেম পর্যায়ের রুপরেখা বদলে যে রুদ্রমূর্তি তার নরম চিবুকে অঙ্কিত করেছে তা রওনক কখনো ভাবেনি। এখন নাইমা কে মনে হয় পাতাহীন রুক্ষ বকুল গাছের মত— তার সাংসারিক হস্তক্ষেপ কে বলা যায় মেছের আলির ক্ষ্যাপলা জালের মত আর নাইমার শরীর যেন অতিরিক্ত নোনতা তরকারির মত—চাখলেই জিহ্বা তুরতুর করে। বউয়ের কথা রেখে রওনক ভাবে তার বোবাকালা ছেলটির কথা। সে কি রওনকের নিস্তব্ধ কন্ঠের বারতা নিয়ে এসেছে? ওর জীবন-ই হয়তো ভালো। রওনকের মত অজস্র কন্ঠ ওর মতই তো অব্যবহৃত ফাঁকা আওয়াজ করে— কেবল শুকনো একটু বাতাস মুখ গলিয়ে বেরিয়ে যায়।
কালেক্টর দ্বরাজ গলায় হাঁকে
— এইইইই বেগুনবাড়ি নামেন-বেগুনবাড়ি। ওস্তাদ বায়ে।
রওনকের ক্ষনিক যাত্রা পথের ভাবনা চুকে গেলে সে নামে। আশেপাশে বস্তী গুলোর চাঁদোয়ার চালা যেন হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। ব্যাগে লেখা ঠিকানায় চোখ বুলালো রওনক।
শামীম শেখ
বেগুনবাড়ি মোড়( দোকানে জিজ্ঞেস করলে ঘর দেখিয়ে দিবে)
ঠিকানার বিষয়বস্তু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ। রওনক দেবে যাওয়া পেটে হাত বুলায় কয়েকবার। বাস ভাড়া দিয়ে একশত আশি টাকা তার মুঠির ভিতরে গরম হচ্ছে। সেখান থেকে ফিরতি ভাড়ার বিশ টাকা সে বুক পকেটে রেখে ফোলা পকেট টা চাপ দিলো। দোকানে যেহেতু জিজ্ঞেস করতে হবে তাহলে একটা বিস্কুট সহযোগে এক কাপ চা তো পেটের অতল গহ্বরে চালান করা যায়। মোড়ের দোকানটায় গিয়ে বসল রওনক। শহরের দোকানে বসা মানেই চা হাজির। তবে শুকনো একটুকরো থ্যাবড়া কেক সে নিজের হাতেই নিলো। রওনক একসময় খেয়ালে বলল,
— শামীম শেখের বাসা টা কোথায় বলতে পারেন?
মনে হয় এ পাড়ায় শামীম নামের একজনের বসবাস। বলতেই দোকানদার দেখিয়ে দিলো ইশারায়। বস্তী ঘেরা এলাকার ভেতর দিয়ে রঙচটা দালানটা মনে হয় ইশারার ম্যাপে। রওনক চায়ে চুমুক দিতেই তার কেমন যেন অনুভূতি লাগে। সামনে মাসের চাকরি খোয়ানোর দোটানা ভাবনা তার চিন্তায় বসে না বরং সে ভাবে গুলশানের আলিশান বাসার একটা মেয়ে বেগুনবাড়ি বস্তীর একটা ছেলেকে কি পাঠালো আর তাও আবার জরুরী। এই তলবের গূঢ়ার্থ জানার কৌতুহল তার রক্তে কেমন শিহরণ জাগালো। মেয়েটির থমথমে অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘাবৃত মুখটি পলকে ভেসে উঠলো আবারও। তবে কি শ্রেনী চেতনার ভয়াবহ আবহে চিত্রিত এই প্রেমিক যুগলের পরাজয়? রওনক আর নাইমা তো একই শ্রেনী থেকে উটে আসা অসুখী দম্পতি। ভালবেসে তারাও তো লক্ষী সপেছিল পাঁয়ে। তারাও তো চেয়েছিল চার দেওয়ালের শান্তি আর স্নিগ্ধতা। তারা চেয়েছিল একটি ফুলেল বাগান—গুটিকয় সফেদ ফুল— সমশ্রেণী থেকেই। পেয়েছে কি? ঘোরের ভেতরেই সে ব্যাগের মুখে খোলে। তার খটকা লাগে জিনিসটা দেখে। সাদা রঙটা যে রওনক প্রথম দেখছে তা না। তার একটা পাঞ্জাবি রয়েছে ধবধবে সাদা। তবে এটা কেমন সাদা ঠাহর হয় না। খানিকক্ষণ আঙ্গুলের ঘষামাজা চলে। যখন সে বুঝতে পারে কাপড়টি প্রাণহীন মানুষের দেহে আবৃত শেষ পরিধেয় তখন তড়িঘড়ি করে চা বিল মিটিয়ে গুলশানের বাস ধরতে ছোটে রওনক। দোতালার সেই মেয়েটির মুখের অন্ধকার কি এখনো জেগে আছে প্রাণ নিয়ে?

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ

আজকের দিন-তারিখ

  • সোমবার (রাত ১২:১৭)
  • ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ২০ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬
  • ৮ পৌষ, ১৪৩১ (শীতকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Sundarban IT