আমরা সাহিত্যাঙ্গনের বহু গুণীজনকে হারিয়েছি এ বছর। বাংলা সাহিত্যের ১১ জন অন্যতম কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিক মারা গেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রাবন্ধিক সুফিয়া খাতুন, কবি আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, ইকবাল হাসান ও কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক পান্না কায়সার। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র ও মলয় রায়চৌধুরী চিরবিদায় নিয়েছেন। তাদের নিয়ে সাহিত্যপাতার বিশেষ আয়োজন।
প্রাবন্ধিক সুফিয়া খাতুন
চলতি বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারি ভোরে দেহত্যাগ করেছেন বাংলাদেশের শতবর্ষী লেখক-প্রাবন্ধিক সুফিয়া খাতুন। তিনি ২০২১ সালে আত্মজীবনীতে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। আলোচিত ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে’ গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ সালে ময়মনসিংহে। এ লেখকের ‘সোনা ঝরা দিন’ শিরোনামের শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত গ্রন্থটিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ ‘আপন ভুবন’, ‘নারীর চোখে জল’, ভ্রমণকাহিনী ‘প্রবাসের প্রাপ্তি’ প্রভৃতি।
কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ২১ জানুয়ারি চলে যান সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্ম নেওয়া এ কবি বর্তমান সময়ে দুই বাংলায় জনপ্রিয়। সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। ‘শীতকাল এসে গিয়েছে সুপর্ণা, আমি মাসের পর মাস ঘুমিয়ে থাকব’-নিজের কবিতার মতোই চিরনিদ্রায় চলে যান তিনি, তাও শীতেই। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-শূন্য রঙের মানুষ, আমরা অনেক কিছু ভুল জানি, অলিভ পার্কের দিনগুলো, তৈরি হচ্ছে শুঁয়োপোকা, এখানে রবীন্দ্রনাথ থাকেন, সাগরিকা হোটেলে ভুল নাম, সব ছবি লেন্সে ওঠে না প্রভৃতি।
কথাসাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র
প্রথাবিরোধী বাংলা ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সুবিমল মিশ্র ৮০ বছর বয়সে ইহলোক ছেড়ে চলে যান ৮ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায় জন্ম নেওয়া এ কথাসাহিত্যিক দুই বাংলাতেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে অসুস্থ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এ সাহিত্যিক। তার ৫০ বছরের সাহিত্যজীবনে কোনোদিন কোনো বাণিজ্যিক পত্রিকায় একটি অক্ষরও লেখেননি। অধিকাংশ বই-ই নিজ দায়িত্বে সম্পাদনা, প্রকাশ ও বিক্রি করেছেন ব্যতিক্রমী এ সাহিত্যিক। ১৯৬৭ সালে তার লেখা ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’ ছোটগল্পটি বাংলা সাহিত্য জগতে প্রথম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তার লেখা অন্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-তেজস্ক্রিয় আবর্জনা, আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারত, হাড়মটমটি, নাঙা হাড় জেগে উঠেছে, কণ্ঠপালক গুঁড়া, রঙ যখন সতর্কীকরণ চিহ্ন, ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে প্রভৃতি।
কবি ইকবাল হাসান
বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কানাডা প্রবাসী কবি ইকবাল হাসান মারা যান ১২ এপ্রিল। কানাডার টরন্টোর মাইকেল গ্যারন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন কবি ইকবাল হাসান। ৭৩ বছর বেঁচে থাকা এ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-অসামান্য ব্যবধান, জোছনার চিত্রকলা, কপাটবিহীন ঘর, দূর কোনো নক্ষত্রের দিকে, দূরের মানুষ কাছের মানুষ, আলো আঁধারে কয়েকটি সোনালি মাছ, চোখ ভেসে যায় জলে, সুখলালের স্বপ্ন ও তৃতীয় চরিত্র, কিছু কথা কথার ভেতরে প্রভৃতি।
কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার
দুই বাংলার কথাসাহিত্যে নক্ষত্রের মৃত্যু হয় ৮ মে। ভক্তদের কাঁদিয়ে এ বছর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। বেশ কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পর ৮১ বছর বয়সে মারা যান উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষসহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা। সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারজয়ী এ সাহিত্যিকের অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-দৌড়, গর্ভধারিণী, অর্জুনসমগ্র, সাতকাহন, ছায়া পূর্বগামিনী, স্বপ্নের বাজার, অনুরাগ, তেরো পার্বণ, সহজপুর কতদূর, সূর্য ঢলে গেলে, আট কুঠুরি নয় দরজা, আমাকে চাই, কেউ কেউ একা প্রভৃতি।
কথাসাহিত্যিক পান্না কায়সার
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপিকা পান্না কায়সার ৭৩ বছর বয়সে মারা যান ৪ আগস্ট। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। সাহিত্য ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন এ সাংবাদিক-লেখক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় ভূমিকার স্বীকৃতি হিসাবে ২০২১ সালে মর্যাদাপূর্ণ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন পান্না কায়সার। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে, নীলিমায় নীল, হৃদয়ে বাংলাদেশ, অন্য কোনোখানে, তুমি কি কেবলি ছবি, রাসেলের যুদ্ধযাত্রা, সুখ, না চুনি না পান্না প্রভৃতি।
কবি মোহাম্মদ রফিক
কবি মোহাম্মদ রফিক মারা যান ৬ আগস্ট। বরিশাল থেকে ঢাকা ফেরার পথেই ৮০ বছর বয়সে চলে যান বাংলাদেশের প্রথিতযশা এ কবি। একজন মননশীল আধুনিক কবি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কবি মোহাম্মদ রফিকের জন্ম ১৯৪৩ সালে বাগেরহাটে। পেশা জীবনে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। কবি হিসাবে ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই পরিচিতি পেতে থাকেন রফিক মোহাম্মদ। ১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশ হয়। তার অন্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ধুলার সংসারে এ মাটি, কীর্তিনাশা, খোলা কবিতা ও কপিলা, গাওদিয়ায়, স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়, মেঘে এবং কাদায়, রূপকথা কিংবদন্তি, মৎস্য গন্ধ্যা, মাতি কিসকু, বিষখালি সন্ধ্যা, কালাপানি, নোনাঝাউ, দোমাটির মুখ প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য মোহাম্মদ রফিক ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। আর একুশে পদকে ভূষিত হন ২০১০ সালে।
কবি আসাদ চৌধুরী
ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী পরপারে চলে যান ৫ অক্টোবর। কানাডার একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে জন্মেছিলেন আসাদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি। আসাদ চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রণিধানযোগ্য ‘তবক দেওয়া পান’, ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’, ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’, ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’, ‘যে পারে পারুক’, ‘মধ্য মাঠ থেকে’, ‘মেঘের জুলুম পাখির জুলুম’, ‘আমার কবিতা’, ‘ভালবাসার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘দুঃখীরা গল্প করে’, ‘নদীও বিবস্ত্র হয়’, ‘টান ভালোবাসার কবিতা’, ‘বাতাস যেমন পরিচিত’, ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই’, ‘কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি’, ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’ প্রভৃতি।
কবি মলয় রায়চৌধুরী
ভারতের বিহারের পাটনায় ১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর জন্ম নেওয়া ‘হাংরি জেনারেশন’ সাহিত্য আন্দোলনের জন্য খ্যাত মলয় রায়চৌধুরী ৮৪ বছর বয়সে মারা যান ২৬ অক্টোবর। তিনি ছিলেন দুই বাংলায় আলোচিত একজন কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক। ১৯৬৪ সালে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় জেল খেটেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মলয় রায়। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, ভেন্নগল্প, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ, এই অধম ওই অধম, শয়তানের মুখ, জখম, হাততালি, চিৎকারসমগ্র, ছত্রখান, মার্কসবাদের উত্তরাধিকার প্রভৃতি।