• আজ- রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:৩৩ পূর্বাহ্ন

হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর

এস এম আশরাফুল ইসলাম / ২২৮ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪

add 1

খোলা জানালার দখিনা বাতাসের শান্তি আপনি নাও পেতে পারেন, ইটপাথরের ঘরে ছাদটা বড্ড গরম হয় গ্রীষ্মকালে। দখিনা বাতাসের সাধ্য কী সেই গরমের অস্বস্তি দূর করে! সত্যিকারের খোলা জানালার সুবিধা নিতে হলে ঘরটা হতে হবে মাটির। এ ঘর এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু দুই দশক আগে এ দেশের গ্রামগুলো ছিল মেটেঘরের প্রশান্তিতে ভরা। মেটেঘরের অনেক রকমফের। থাকার ঘর, রান্নাঘর, বহির্বাটির বৈঠকঘরগুলোও মেটেঘরের তিনটা ঘর। তবে গৃহস্থবাড়ির অন্য ঘরগুলোও সাধারণত বাঁশ-বেড়ার তৈরি। একটা উঁচু পোতা, যেটিকে দালান ঘরে বারান্দা বলে, তার ওপরের চার দেয়ালের ওপর পাঁচ চালের ঘর। সে ঘর একটাও হতে পারে, পাশাপাশি একাধিকও হতে পারে। এটিই আসলে থাকার ঘর।

এই ঘরের পোতা উঁচু করা হতো আসলে সাপ বা অন্য প্রাণীগুলো যেন সহজে আক্রমণ করতে না পারে। তা ছাড়া ছিঁচকে চোরদের উঠতেও যেন বেগ পেতে হয়। তবে সবচেয়ে বড় কারণ বর্ষার জল। বৃষ্টির পানি জমে অনেক সময় উঠান ডুবে যেত, ঘরের পোতা উঁচু হলে সেই পানি ঘরে ঢুকতে পারে না।
ঘরের চাল তৈরি হতো উলুখড়, কাশফুলের খড়, ছন, গোলপাতা, গমে কিংবা ধানের খড় দিয়ে। যেদিকে যেটি বেশি সহজলভ্য, সেখানে সেটিই ব্যবহার করা হতো। আরামদায়ক ঘরের চালের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ছিল উলুখড়। তবে সেটি শুধু সম্ভ্রান্ত কৃষকরা ব্যবহার করতে পারত। কারণ, অতটা সহজলভ্য নয় এই ঘাস। তাই গমের নাড়া-ই ছিল মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মূল ভরসা। আর ধানের খড় অতটা টেকসই নয়। পানিতে সহজেই পচে যায়। অবশ্য হাঁস-মুরগির ঘরের চাল দেওয়ার জন্য এই ধানের খড় ব্যবহার করা হতো। তবে দ্ররিদ্র মানুষের থাকার ঘরের চালেও দেখা যেত ধানের খড়। সুন্দরবন এলাকার মানুষের চালে এখনো গোলপাতার ছাউনি দেখা যায়। অনেকে আবার বছর বছর খড় পাল্টাতে রাজি ছিল না, তাই মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা টালির চালও দেখা যেত গাঁয়ে। তবে এখন খড় বা গোলপাতার চল উঠেই গেছে প্রায়। গ্রামে এখনো যেসব কাঁচা ঘর দেখা যায় সেগুলোর চাল টিন দিয়ে তৈরি। টিনের ঘরের চালের কাঠামো খড়ের কাঠামোর মতো, বাঁশ দিয়ে তৈরি। ঘরের চাল তৈরি হতো পিরামিডের মতো করে বাঁশের কাঠামো তৈরি করে। এর চারপাশে চারটি আলাদা চাল। চালের ওপরে দিকে আড় করে রাখা হতো একটা বাঁশের আড়া। এটিকেই বলে মটকা। মটাকার বাঁশটিকে আলাদাভাবে খড় দিয়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হতো, সেটি দুদিকের চালের সঙ্গে এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হতো যেন পানি ঢুকতে না পারে।

বেশির ভাগ থাকার শোবার ঘর পাঁচ চালাই হতো। তবে কেউ কেউ মূল ঘরের সঙ্গে আলাদা ছোট ছোট ঘর করতে হাঁস-মুরগি, ছাগল ইত্যাদি রাখার জন্য ছোট ঘর করা হতো। তার জন্য ঘরের চাল একটা বাড়ানো হতো। এসব মিলিয়ে থাকার ঘরটাকে বলা হতো ছয়চালা ঘর। উঁচু পোতায় ওঠার জন্য তৈরি করা হতো কাঁচা সিঁড়ি। দুই কিংবা তিন ধাপের সিঁড়ি। আঞ্চলিক ভাষায় এর নাম পটে। উঁচু পোতাটা আসলে বারান্দা। সামনের দিকটি পুরো খোলামেলা। পরিবারের বৃদ্ধ আর শিশুরা এই বারান্দেতাতেই শুত। শীতের হাওয়া কিংবা ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সামনের দিকে টাঙিয়ে দেওয়া হতো শাড়ি কাপড়। তবে বেশির ভাগ সময় খোলা রাখা হতো, তাই দখিনা বাতাসের স্বাদটুকু পুরোপুরি নিতে পারত বৃদ্ধ বা শিশুরা।

কাঁচা ঘরের দেয়াল তৈর হয় কাদা দিয়ে। শুকনো এঁটেল মাটি ভিজিয়ে আগে মণ্ড বা খামির বানানো হয়। এরপর সমান করা মাটির ওপর দাগ কেটে দেয়ালের নকশা তৈরি করা হয়। তারপর সেই দাগের পর একের পর এক কাদার মণ্ড বসিয়ে দেয়াল তোলা হয়। কাঁচা দেয়াল শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে নিড়ানি দিয়ে চেঁছে দেয়াল মসৃণ ও সমান করা হয়। দেয়াল ও মেঝে ঠিক করার জন্য লেপতে হয় সেগুলো। মাটির ঘর হারিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এগুলোর সংরক্ষণ যে জরুরি, তাও নয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যত ভালো হচ্ছে, ঠিক ততটাই কমছে কাঁচা ঘরের সংখ্যা। এ নিয়ে আফসোস করারও কিছু নেই। বরং অতীত সংস্কৃতি ও বেঁচে থাকার এই অত্যাবশ্যকীয় ইতিহাস নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Sundarban IT