“কী ব্যাপার অফিস থেকে এসেই রান্না ঘরে ঢুকলে কেন?”
– “ভাবছি রাতের রান্নাটা আজ আমিই করব।”
মিলি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি রাঁধবে? তুমি!”
– হ্যাঁ, এত অবাক হবার কী আছে?
– না মানে, তোমাকে প্রথম রান্না করতে দেখছি তো তাই। আচ্ছা শেষ পর্যন্ত খাওয়া যাবে তো?
– টিটকারি করছ?
– না না, একদম টিটকারি করছি না।
শিউলির মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে আছে।
পুরুষদের সম্পর্কে নারীদের ধারণা খুবই সীমাবদ্ধ। তাদের ধারণা পুরুষ মানুষের কাজসমূহ হচ্ছে, সকাল সকাল অফিসে যাওয়া, রাত করে বাড়ি ফিরে আসা, খাওয়া-দাওয়া করা, টেলিভিশন দেখা, মহল্লার চায়ের দোকানে বসে আড্ডাবাজি করা, আর ঘুম-এসব ছাড়া পুরুষ মানুষ আর কিছুই করতে জানে না। আমি ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করে পানিতে ভিজিয়ে রেখে, ঘর থেকে জামাকাপড় বদলে আবারও রান্নাঘরে ফিরে আসলাম।
রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমেই আমি পেঁয়াজ নিয়ে বসলাম। দেশী পেঁয়াজ কাটতে গেলেই আমার চোখ ভিজে যায়। ব্যাপারটা মন্দ লাগে না, মাঝে মধ্যে কান্নার চর্চা থাকা ভাল- চোখ পরিষ্কার থাকে। সব সময়ের মতো আজকেও যথারীতি পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে গিয়ে চোখ থেকে অঝরধারায় জল ঝরতে শুরু করল।
মিলি ফ্রিজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার পেঁয়াজ কাটা দেখছে। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই ও বলল, “কি কি কাটতে হবে আমাকে বলো, আমি কেটে দিচ্ছি।”
আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বললাম, “হাসি-ঠাট্টা করে মেজাজ খারাপ করে দিয়েছো, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। যে রাঁধতে জানে সে কাটতেও জানে।”
– তাই বুঝি! খুব ভাল কথা, দেখো আবার হাত কেটে নিয়ো না যেন।
– তুমি আমার মনোযোগ নষ্ট করে দিচ্ছ।
– ঠিক আছে বাবা গেলাম আমি, কিছু লাগলে ডেকো।
মিলি চলে গেল।
আমি পেঁয়াজ কাটা শেষ করে মরিচ কাটতে গিয়ে বুঝলাম, আমার হাতের আঙ্গুল ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ কাটা পড়েছে, মরিচের ঝাল লেগে আঙ্গুল জ্বলতে শুরু করেছে। মিলিকে আঙ্গুল কাটার ব্যাপারে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না, কোনোভাবে বুঝতে পারলে এ নিয়েও হাসি-তামাশা শুরু করে দেবে। হাতে পানি দিয়ে আমি ধীর গতিতে কাটাকুটির কাজ শেষ করলাম।
আজ ইচ্ছা করছে কাঁচা মরিচের বাটা দিয়ে মাংস কষিয়ে রাঁধতে। রান্নাঘরে শিল-পাটা খুঁজে পাচ্ছি না। ব্লেণ্ডারটা বেশকিছুদিন হলো নষ্ট হয়েছে, নতুন ব্লেণ্ডার এখনো কেনা হয়নি। আমি মিলিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “শিল-পাটা কোথায়?”
মিলি রান্নাঘরে ঢুকে অদ্ভুতুড়ে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “শিল-পাটা দিয়ে কি হবে?”
– কাঁচামরিচ বাটব। আদা-রসুন বাটা আছে তো? নাকি ওসবও বাটতে হবে?
– নাহ ওসব আছে, মরিচ আমি বেটে দেই?
– লাগবে না, আমিই বেটে নেবো।
– হাত জ্বালা করবে কিন্তু।
– ঢং করো না তো।
– ঠিক আছে বাবা আর ঢং দেখাচ্ছি না, গেলাম আমি।
মিলি শিল-পাটা আর আদা-রসুন বাটা বের করে দিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গেল।
এই হচ্ছে মহিলা মানুষ, এরা মনে করে পুরুষ মানুষ হচ্ছে অকর্মণ্যের ঢেঁকি, তাদের দ্বারা কিছুই করা সম্ভব না। বিয়ের পর রান্না-বান্না তেমন একটা করা হয় না। বিয়ের আগে যখন রাঁধতাম, তখন মা’ও মিলির মতো এসে বার বার জিজ্ঞাসা করত, ‘কী করে দিতে হবে, আমাকে বল, আমি করে দিচ্ছি।’ ধমক না লাগালে মা আর যেতো না।
আনমনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পাটাতে মরিচ বাটতে গিয়ে আচমকা আঙ্গুলের কাটা অংশে তীব্র জ্বালা শুরু হবার পর আমার মনে পড়ল, মরিচ কাটতে গিয়ে হাতের আঙ্গুল কেটেছে। আমি কল ছেড়ে আঙ্গুলে পানি ঢালতে গিয়ে দেখলাম, আঙ্গুলের কাটা অংশে মরিচের একটা বেয়াদব বিচি ঢুকে আছে। এই ক্ষুদ্রতম মরিচের বিচির যেই পরিমাণ দংশনের ক্ষমতা আছে পৃথিবীর অন্য কিছুর এত ক্ষমতা আছে বলে আমার মনে হয় না। মরিচের ক্ষমতার উপর পর্যালোচনা করে আমি মরিচকে উপাধি দিয়েছি- “দ্যা সুপার ডেঞ্জারাস এনিমি।” এই নাম দেওয়ার পেছনে একটা বিশেষ কারণ আছে। মরিচের দল সর্বদা সুযোগের সন্ধানে থাকে, সুযোগ পেলেই এরা বিস্ফোরিত হয়ে মানুষকে একদম কাবু করে ফেলে। দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর আজ তাদের মনের খায়েস পূরণ হয়েছে। আমার আঙ্গুলে তারা বিস্ফোরণ ঘটাতে পেরেছে, এই কাটা আঙ্গুলে মরিচ বাটা যাবে না। আমি ঘরে গিয়ে মিলির চোখ ফাঁকি দিয়ে আঙ্গুলে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আবারও রান্নাঘরে ফিরে এলাম। এরপর মরিচ বাটা শেষ করে চুলায় কড়াইতে মসলা কষিয়ে মাংস ছেড়ে দিলাম। ইতোমধ্যে গরমে আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আমি কড়াইতে ঢাকনা দিয়ে বাথরুমে গিয়ে দ্রুত গোসল সেরে ফের রান্নাঘরে এলাম।
বেশকিছুক্ষণ পর মিলি এসে রান্নাঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার আপনার রান্না কতদূর?”
আমি হাত পকেটে ঢুকিয়ে বললাম, “এইতো শেষের দিকে।”
– শুধু মাংস রাঁধলেই হবে? ভাত রাঁধবে কে?
– ভাত রান্না হয়নি?
– হবে কোথা থেকে? সেই যে অফিস থেকে এসে রান্নাঘরে ঢুকেছেন, কিছু কী করতে দিয়েছেন?
– ভাত হতে আর কতক্ষণ! তুমি যাও, আমি ভাতের চাল বসিয়ে দিচ্ছি।
মিলি কিছু না বলে ভেংচি কেটে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মিলির কয়েকটা অঙ্গ-ভঙ্গির মধ্যে ভেংচি কাটা আমার বিশেষ পছন্দের। এরকমভাবে ভেংচি কাটলে বেশির ভাগ মানুষকে চিরিয়াখানার বানরের মতো দেখায় কিন্তু ওকে ভীষণ সুন্দর দেখায়। ও চলে যাবার পর আমি চাল ধুয়ে অন্য চুলায় বসিয়ে দিলাম।
রান্না-বান্না শেষ হবার পর আমি মিলিকে ডাকলাম।
মিলি কপাল ভাঁজ করে রান্নাঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”
আমি বললাম, “রাঁধব বলেছিলাম রেঁধেছি, টেবিলে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তো নেইনি। খাবার বেড়ে টেবিলে নিয়ে যাও।”
মিলি মুচকি হেসে বলল, “সেই তো আমাকে প্রয়োজন পড়লই। যান ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসুন।”
– নিয়ে যাবার সময় মাংসে কয়েক চামচ লবণ দিয়ে বোসো না যেন।
মিলি রেগে গিয়ে বলল, “আমি কিছু নিয়ে যেতে পারব না। কষ্ট করে রেঁধেছো, কষ্ট করে টেবিলেও নিয়ে যাও। যে রাঁধতে জানে সে পরিবেশনও করতে জানে।”
মিলি ভীষণ ক্ষেপেছে। ও রাগলে ওর গাল দুটো লাল হয়ে যায়, চোখে তেজ ঝরে পড়ে ওকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। আমি ওকে দ্বিতীয় দফা রাগানোর জন্য বললাম, “কী সব রান্না কর মুখ দিয়ে ঢুকতে চায় না, আজ আমি রেঁধেছি, খেয়ে দেখো।”
মিলি কিছু বলার আগেই আমি দ্রুত রান্নাঘর থেকে কেটে পড়লাম।
মিলি এখন কিছুক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করবে, এরপর টেবিলে একে একে প্লেট-গ্লাস, ভাত, মাংসের ভুনা নিয়ে যাবে। এরকম আগেও হয়েছে তা না, তবে আমি ওর গতিবিধি বুঝতে পারি। ও এখন রাগের দ্বিতীয় সীমায় আছে, এর বেশি রাগালে খবর আছে। রাগের তৃতীয় সীমা লঙ্ঘন করলে ও বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।
আমি বাথরুমে ঢুকে আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে আব্বার পাশের চেয়ারে বসলাম।
আব্বা-আম্মা, নিশাদ, বিথী সবাই খাওয়া শুরু করেছে, মিলি শুধু আমার জন্যে এখনও বসে আছে। আমি বসতেই ও আমার প্লেটে ভাত-মাংস বেড়ে দিল।
আমি এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছি এমন সময় আব্বা বলে উঠলেন,
“বউমা আজকের মাংসটা খুব ভাল রেঁধেছো। কাঁচা মরিচের ঝালটা ভাল লাগতেছে। দাও আরেকটু দাও।”
আব্বার প্লেটে মাংস তুলে দেওয়ার সময় বিথী বলল, “ভাবি মাংসে ঝালটা একটু বেশি হয়েছে কিন্তু জোশ হয়েছে।”
আম্মা বলল, “ঝাল হইছে দেখেই তো মজা লাগতেছে, দাও বউমা আমাকেও একটু দাও।”
মিলির মুখটা কালো হয়ে আছে, এর কারণ হচ্ছে সবাই ওর রান্নার প্রশংসা করছে কিন্তু রান্না তো ও করেনি। রান্না করেছি আমি, এখন সবাইকে ওর বলতে হবে, রান্না তো আমি করিনি, রান্না করেছ মাহমুদ । আমার উপর রেগে থাকায় আমার নাম ও মুখে আনতে চাইছে না কিন্তু না এনেও আর উপায় নেই কারণ তাহলে ও মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে। আমি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছি।
আব্বা আবার বললেন, “বউমা মাঝে মাঝে এইভাবে রান্না কইরো, ভিন্ন স্বাদ ভালোই লাগে।”
মিলি বলল, “বাবা রান্নাতো আমি করিনি, আপনার ছেলে রেঁধেছে।”
আব্বা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললেন, “তুই রান্না করছিস?”
আমি সগর্বে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
আম্মা আমাকে নিয়ে ছোট থেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আব্বাকে উদ্দেশ্য করে আম্মা বলল, “মাহমুদ যে ছোট থেকেই ভাল রান্না করে তা মনে হয় আপনি জানেন না? যারাই ওর রান্না খেয়েছে সবাই প্রশংসা করেছে।”
আব্বার মনে হয় জ্বলতে শুরু করেছে। এতক্ষণ রান্নার প্রশংসা করলেও আমি রান্না করেছি জানতে পেরে তিনি বিরক্তমুখে বললেন, “এত ঝাল খেলে গ্যাষ্ট্রিকের সমস্যা হয়ে যাবে।”
ব্যাপারটা অনেকটা এমন, কিছুক্ষণ আগে তাঁর বউমা রেঁধেছিল তাই সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, খুব স্বাদ হয়েছিল। আমি রান্না করেছি জানার পর একে একে খুঁত বের হতে শুরু হয়েছে।
খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায়ে এলাচে কামড় পড়ায় আব্বা বললেন, “এতো এলাচ দিছিস কেন?”
আমি আড়চোখে মিলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসছে। আনন্দে ও আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। আম্মা আব্বাকে বলল, “শুধু শুধু খুঁত বের করতে শুরু করেছেন, নিজে তো রান্নার ক’ও বোঝেন না, অন্যের রান্নার দোষ বের করছেন।”
আব্বা রেগে গিয়ে বললেন, “কী! আমি রান্নার ক’ও বুঝি না? জীবনে তো কম রান্না করে খাওয়াইনি, এত বড় অপবাদ!”
– খাইয়েছেন তো, তা তো আর অস্বীকার করছি না কিন্তু কোনোদিন তেল বেশি, কোনোদিন লবণের জন্যে মুখে দেওয়া যায় নাই। তাও যে খেয়েছি সেটাই তো আপনার ভাগ্য। কারন রান্না যেমন এ হোক তাতে আপনার ভালোবাসা ছিল রান্না টা আপনি আমাকে ভালোবেসে আমাকে খুশি করার জন্য করছেন।মায়ের কথা শুনে আব্বা এতোটা লজ্জা পেয়েছে যে কোন মতে খাবারটা খেয়ে হাত দুয়ে নিজের রুমে চলে গেল।আর মিলি আম্মা সহ সবাই আব্বার এমন অবস্থা দেখে মিট মিট করে হাসতে লাগলো। আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করে বাড়ির ছাদে চলে গেলাম।
ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারির পর আমি মিলিকে মেসেজে লিখে পাঠালাম, “দুই কাপ চা নিয়ে ছাদে এসো।”
মিলি প্রতুত্ত্যরে লিখল, “পারব না।”
কিন্তু আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই ও দুইটা কাপ আর চায়ের ফ্ল্যাক্স নিয়ে ছাদে হাজির হবে।
মিনিট দশেকের মধ্যে মিলি চায়ের কাপ আর ফ্ল্যাক্স হাতে ছাদে চলে এলো। চায়ের কাপ-ফ্ল্যাক্স ছাদের রেলিংয়ে রেখে ও আমকে বলল, “দেখি হাত দেখি।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন?”
– কতটুকু কেটেছে দেখি।
আমি বললাম, “কই কাটেনি তো।”
মিলি আমার ডান হাতে মুঠোফোনের আলো ফেলে আঙ্গুল উঁচু করে ধরে বলল, “ভালই তো কেটেছে।”
– আঙ্গুল কেটেছে তুমি জানলে কী করে?
– আমি সব জানি।
– আর কী কী জানো তুমি?
আমার আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে মিলি বলল, “আপনার নাড়ি-নক্ষত্র পুরোটাই জানি।”
– কী করে জানো?
ভালোবাসি তো তাই সব জানি।
– এই বলো আমার বুকে মুখ লুকালো মনে হলো এটা তার সুখের ঠিকানা। আমি মিলিকে বুকে আগলে দরে মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে দিলাম।