ঝিলি, মিলি, আর রৌদ্রর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ ।পরিক্ষার পরেই পুরো একটানা পনেরো দিনের
বন্ধ দিয়েছে স্কুল। ওদের বাবা শিশির আহমেদ একজন বেসরকারি চাকুরী জীবি। মা বিন্দু বেগম গৃহীনি। মেয়ে ঝিলি সবার বড় সে এবার নবম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। তারপর মিলি সপ্তম শ্রেণীতে। আর সবার ছোট ছেলে রৌদ্রর সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। মেয়ে দুটি পিঠোপিঠি হলেও ছেলে রৌদ্রর বোনদের চেয়ে প্রায় পাঁচ ছয় বছরের ছোট।
অবশ্য এমনটা হওয়ারও ঢের কারণও আছে।৷
মেয়ে ঝিলি আর মিলির জন্মের পর ওদের বাবা-মা, শিশির আহমেদ আর বিন্দু বেগম ভেবেছিলো তারা আর কোন সন্তান নেবে না।
মেয়ে দুটোকে নিয়েই তারা তাদের বাকি জীবনটা পার করে দেবে। ছেলে হয়নি তাতে কি? বাংদেশে এমন অনেক পরিবার আছে। যেসব পরিবারের
মেয়েরা পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে আজ তারা সব সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরিবাকরি করছে।
তারা সব নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়ে তাদের বাবা-মার দায়িত্বও নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। শিশির আর বিন্দুর দুজনের এমন চিন্তা
ভাবনা থাকলেও। তাদের উভয়ের পিতৃলয়ের লোকজন। বিশেষ করে তাদের মা-বাবাদের জোরাজুরিতে শেষমেশ তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। একদিকে শিশিরের মা-বাবা বলে, আমরা পুঁতার মুখ দেখে মরতে চাই। অন্যদিকে বিন্দুর বাবা-মা বলে আমরা নাতির মুখ দেখতে চাই। এদিকে শিশির আর বিন্দু দুজন মনে মনে একটু ভয়ও পাচ্ছিল।
এই ভেবে যে, ছেলের আশায় আবারো যদি তাদের মেয়ে হয়! যাহোক বিশ্বের মহান স্রষ্টা তার বান্দা-বান্দীর জন্য যেটাই করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। স্রষ্টার উপর ভরসা করেই তারা শেষে সন্তান নিলে ছেলে রৌদ্রর জন্ম হয়।
শিশির আর বিন্দুর জন্মস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল। খুলনা বিভাগের পশ্চিমে বৃহৎ বাণিজ্যিক স্থলবন্দর বেনাপোল সীমান্তের প্রায় নিকটবর্তী। যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার অদূর দক্ষিণে আট কিলোমিটার দূরে নারাংগালী গ্রামে। চাকুরির সুবাদে শিশির বউ সন্তান সবাইকে
নিয়ে এখন ঢাকা ধানমন্ডির একটা ফ্লাটে ভাড়া থাকেন। শিশিরের স্ত্রী বিন্দুর বাপের বাড়ি নারাংগালীর গ্রামের পশ্চিম পাশের গাঁ পানিসারা
গ্রামে। বর্তমান যে গ্রাম ফুল চাষে বিখ্যাত। আর
পানিসারা গ্রামের একটু উত্তরে যশোর বেনাপোল
সড়কের সাথে গদখালি বাজার। যে বাজারটিকে
বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী নামে কমবেশি সকলেই চেনে জানে।
শিশির আহমেদ সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরার পর
পরিবারের সবাই ডাইনিং টেবিলে রাতের ডিনার করতে বসেছে। শিশিরের স্ত্রী বিন্দু সবার পাত্রে খাবার তুলে দিচ্ছে। খেতে খেতে হঠাৎ রৌদ্রর বললো, জানো আব্বু আমাদের আজ স্কুল থেকে শীতের বন্ধ দিয়েছে হুম..।
শিশির,..মুখে হাসির রেশ টেনে বললো তাই নাকি বাবা ? খুব ভালো।
তারপর, ঝিলি, মিলির দিকে তাকিয়ে বললো কি মা-মণিরা তোমাদেরও স্কুল বন্ধ দিয়েছে নাকি?
ঝিলি, বললো জ্বি, আব্বু দিয়েছে।
মিলি: আমাদেরও স্কুল বন্ধ দিয়েছে আব্বু।
বিন্দু চুপচাপ ওদের বাপ ছেলে মেয়েদের কথা শুনছে আর শিশিরের পাশের চেয়ারে বসে খাচ্ছে।
শিশির বললো: হুম, এজন্য দেখছি আজ সবার
মনটা ভীষণ হাসিখুশি। আমার সারা বাড়িটা এত
রাতেও জ্যোস্নার আলোয় ঝলমল করছে।
তা- এখন তো তোমাদের কারোর বই পড়া নেই।
এই ছুটির দিন গুলোতে সব কি করবে ভাবছো? ওপাশ থেকে ঝিলি বলে উঠলো চলো না আব্বু, এই শীতের ছুটিতে আমরা সবাই আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। মিলি, তখন একটু উৎফুল্ল দৃষ্টিতে ঝিলির দিকে তাকিয়ে বললো ইশ! তাহলে ভারি মজা হবে আপু। আমিও আব্বু
কে এই কথা বলবো বলে ভাবছিলাম।
রৌদ্রর বললো, কি মজা হবে-রে আপু?
মিলি কথা বলতে যাবে…সেসময় মা, বিন্দু বেগম বললো বুঝতে পারছিস না রৌদ্রর? শহরে যে বন্দী পাখির মত থাকতে হয়। মন খুলে মুক্ত মনে কোথাও ঘুরতে পারেনা। গাঁয়ে গেলে পাখির মত কদিন এদিকসেদিক ডানা মেলে মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়াতে পারবে সেজন্য।
মিলি বললো, আম্মু তুমি যে কি বলোনা। আমি বুঝি পাখি! আমার কি কোন ডানা আছে যে আমি উড়বো?
ঝিলির কথা শুনে সকলেই হেসে উঠলো। বিন্দু বললো, আরে, বাবা ওটা তো আমি কথার কথা
বললাম। তারপর গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, ভাগ্যিস আমার মেয়েটার ডানা নেই। তা- না হলে উড়ে কোথা থেকে, কোথায় যেতো। শেষে আর আমার মেয়ে-টাকে খুঁজে পেতাম না।
ঝিলি মুখটা একটু অন্য রকম করে বললো, হুম যাও…আমি তো যেতে চাইছি দাদু নানুদের গাঁয়ের মাঠের এই শীতের খেজুরের রস। আর গরম গরম পায়েশ, পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা খাওয়ার জন্য। আর তাছাড়া আম্মু তোমরাই তো বলো। যে, আমরা সব যশোর জেলার মানুষ। যে যশোর জেলা খেজুর রস গুড়ের জন্য সারা বাংলাদেশের
মধ্যে বিখ্যাত। কি বলোনা? সেই আমরা যশোরের মানুষ হয়ে যদি রস গুড় পিঠাপুলি ওসব না খায়। তাহলে যশোরের মানুষ বলে গর্ব করার আরকিছু
থাকবে আমাদের বলো?
পাশ থেকে রৌদ্রর বললো, তুই ঠিক বলেছিস আপু। আহা! গরম রসের মধ্যে পাট কাঠিতে করে
বানিয়ে জড়ি পিঠা খেতে কি যে মজা।
বড় মেয়ে ঝিলি এতক্ষণ মিলি আর রৌদ্রর কথা
শুনছিলো। শেষে সে বললো আমার ভালো লাগে
সকালে গাছ থেকে পাড়া টাটকা জিরেন কাঠের
রস মুড়ি কিম্বা ছোলা দিয়ে খেতে।
ছেলে-মেয়েদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বিন্দু শিশির-কে বললো ওগো, ছেলে মেয়েরা যখন এত করে সব যেতে চাচ্ছে তা- চলো না ঘুরে আসি।
শিশির বললো, হুম, আমিও সেটাই ভাবছি বিন্দুৃ।কিন্তু অফিস থেকে ছুটি পাবো কিনা?
বিন্দু বললো, কেনো পাবে না? তুমি তো কখনো
ইচ্ছা করে অফিস বন্ধ করোনা তাইনা?
শিশির: হুম সেটা ঠিক বলেছ। আচ্ছা দেখি কাল
অফিসে গিয়ে। বসকে বলে যদি ছুটি পাই তাহলে
পরশু সকালে সব গেলে হবে। তারপর কথা শেষ করে শিশির হাত মুখ ধুয়ে উঠে বেডরুমে গেলো।
শিশির উঠে রুমে যেতেই…
তিন ভাই বোন উল্লাসিত হয়ে সবাই একসাথে ইয়েহ! বলে সব হাত মিলালো। তারপর সব চোখ টিপাটিপি করে মুখে হাসি এনে মা বিন্দু বেগমকে উদ্দেশ্য করে একসাথে বলে উঠলো থ্যাংকস আম্মু। তুমি আমাদের লক্ষ্মী আম্মু। রৌদ্রর ওঠে
বিন্দু বেগমের গালে একটা ছোট্ট চুমু দিতে দিতে বললো তুমি না খুব ভালো আম্মু।
বিন্দু বেগম হেসে বললো থাক…থাক..হয়েছে।
আর আমাকে অতো সব প্রশাংসা করতে হবে না।
তিন ভাই বোন বিন্দু বেগমকে এত খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানানোর কারণ সে জানে। ছেলে-মেয়েদের পক্ষ নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ওদের বাপের সাথে উকালতি করার পুরস্কার এটা।
তারপর বললো, এখনি এত উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। আগে সব দ্যাখো, তোমাদের আব্বু অফিস থেকে ছুটি পাই কিনা…।
শুনে ওদের সবার মুখ বেজায় মলিন হয়ে গেলো। ঝিলি বললো, প্লিজ! প্লিজ! আম্মু।
তুমি একটু আব্বুকে বলো অফিসের বসকে যেনো একটু বুঝিয়ে বলে প্লিজ!
বিন্দু বললো, আচ্ছা দেখি কি করা যায়। এখন যাও যে-যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সবাই ডিনার শেষে শুভ রাত্রি আম্মু বলে ঘুমাতে চলে গেলো।
বিন্দু বেগমও ওদের তিন ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে বললো শুভ রাত্রি।
রাতে বিন্দু ঘুমানোর আগে ছেলে-মেয়েদের হয়ে শিশিরকে খুব করে বুঝিয়ে বললো।
শিশির বললো, ঠিক আছে আমি বসকে বুঝিয়ে
বলবো বিন্দু। এখন ঘুমাও। সারাদিন এমনিতেই তোমার উপর বেশ ধকল যায়।
তারপর যে-যার মত পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে শিশির তার অফিসে গিয়ে একটা ছুটির দরখাস্ত হাতে নিয়ে বসের রুমের দরজা ঠেলে বললো আসবো স্যার?
বস মহিম উদ্দিন, শিশিরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে বললো শিশির আহমেদ? আরে, আসুন… আসুন… ভিতরে আসুন।
শিশির, সালাম দিয়ে রুমের ভিতরে যেতেই…
মহিম উদ্দিন, চেয়ার দেখিয়ে বললো বসুন।
শিশির বসকে ধন্যবাদ দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।
শিশির বসতেই মহিম উদ্দিন বললো তারপর বলুন কি খবর? হাতের দিকে নজর যেতেই বললো হাতে ওটা কি?
শিশির কাগজটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে সব বলে। ছুটির কথা বসকে বলতেই। বস হেসে উঠে বললো। হুম, অনেকদিন হলো আপনি কোন ছুটি নেননি। ছেলে-মেয়েরা যখন যেতে চাইছে আর দেরি করবেন না। একঘেয়েমি শুধু তো আর অফিস করলে হবে না তাইনা? একটু আধটু বউ সন্তান-দের সাথেও সময় দিতে হবে বুঝলেন? আর দেরি করবেন না যান…।
শিশির বললো, জ্বি স্যার। তারপর বসকে সালাম দিয়ে হাসি মুখে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
অফিস শেষে সন্ধ্যার পর শিশির মুখ একটু গম্ভীর ভাব করে বাড়ি ফিরলো। বাপের মুখ দেখে তিন ভাই বোন ভাবলো হয়তো ছুটি পাইনি।তাদের
আশা সব জলে গেলো।
বিন্দু শিশিরের হাতের ব্যাগ নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলো মন খারাপ কেনো ছুটি দেয়নি?
বিন্দু বেগমের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাব থেকে ওঠে এসে ধীরে ধীরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো। হুম, দশ দিনের ছুটি পেয়েছি বিন্দু্। আগামীকাল সকালের ট্রেন ধরেই আমরা যশোর যাচ্ছি। সবার মুখে হাসি ফিরে এলো।
তিন ভাই বোন বললো, সত্যি বাবা তাহলে আমরা যাচ্ছি? কি আনন্দ হুররে?
পরেরদিন সকালের ট্রেনে সকলে গ্রামের বাড়িতে গেলো। সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে মহাখুশি শিশির এর বাবা-মা পরিবারের অন্যরা সবাই। বেশ আনন্দে কাটলো সারাটাদিন। পরেরদিন সকালে দাদু দাদী চাচাতো ভাই বোনরা সবাই বসে রোদ পোহাচ্ছ। ঝিলি, মিলি, রৌদ্ররও ঘুম থেকে ওঠে মুখ ধুয়ে সেখানে গেল। সবার সাথে ছোলা মুড়ি দিয়ে রস খেলো। রৌদ্রর দাদুকে উদ্দেশ্য করে বললো। শীতের রোদ খুব মিষ্টি তাইনা দাদু ভাই?
দাদু তুষার আহমেদ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। এখন অবশ্য রিটায়ার্ড হয়ে অবসরে আছেন। খুব ভালো মনের রসিক প্রকৃতির মানুষ।
হেসে বললো, হুম,একেবারে আমার রৌদ্রর দাদু
ভাইয়ের মত। শুনে সকলে হেসে উঠলো। তখন
দাদু তুষার আহমেদ বললো জানো? এই শীতের সকালের রোদ শুধু মিষ্টি লাগে তা নয়। শীতের সকালবেলার সূর্যের রোদে আছে প্রচুর ভিটামিন
এ, ডি। যেটা চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি করে। আর এই
ভিটামিনের অভাবেই মানুষের রাতকানা রোগ হয়।
রৌদ্রর বললো: তাই দাদু ভাই? তাহলে তো দাদু আমাদের সকলের শীতের দিনে সকালের রোদ পোহানো উচিত।
দাদী বৃষ্টি বেগম বললো: হুম, এইতো আমাদের
দাদু ভাই বুঝতে পেরেছে। তুষার আহমেদ বললো
বুঝতে হবেনা আমার রৌদ্রর দাদু যে এই তুষার
মাস্টারের পুঁতা। বৃষ্টি বেগম হেসে ওঠে বললো, তা- যা বলেছ।
পরপরই নাস্তা খেতে ডাকতেই সবাই বাড়ি গিয়ে
একসাথে নাস্তা করলো। দুপুরে নানান রকম পিঠা
খেয়ে বিকালে চাচাতো ভাই বোনদের সাথে কপোতাক্ষ নদের ব্রিজ দেখতে গেল। নদীর তীরে ঘুরে খুব আনন্দ করলো সবাই। বিকেলে গেলো পানিসারায় নানুদের বাসায় বেড়াতে। সেখানে সদ্য
গড়ে ওঠা পিকনিক কর্ণারে ঘুরে নানান রকম ছবি তুললো। তারপর ঘুরে ঘুরে রাস্তার আশেপাশের জমিতে রোপন করা হরেকরকমের ফুল বাগানের ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করলো । সেখানে নানা-নানিরও খুব আদর পেলো। শীতের নানান রকম পিঠা খেলো সবাই।এভাবে হাসি আনন্দের মধ্যে কেটে গেলো তাদের বেশ কয়েকটিদিন। তারপর একসময় শিশির আহমেদের ছুটি শেষ হওয়ার আগেরদিন।
ওরা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্ব-পরিবারে আবারো বিকেলের ট্রেন ধরে সব ঢাকার বাসায় ফিরে এলো।