ছোটবেলা থেকেই সুমন খুব বুদ্ধিমান, বাবা মায়ের একমাত্র আদরের ছেলে সুমন। বাবা রত্নেশ ঢালি শহরের সবথেকে বড় হাসপাতালের ডাক্তার, মা বৈশালী ঢালি স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা। দুবছর বয়স হলে বাবার কিনে আনা রঙিন ছবি দেওয়া অক্ষর পরিচয়ের বই খুব তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে ফেলেছিল সুমন। ওর পড়াশোনার প্রতি আগ্ৰহ দেখে মা সন্ধ্যাবেলায় পড়াতে বসত সুমনকে নিয়ে। ওর পড়ার উৎসাহে নানারকমের ছবি দেওয়া ছড়ার বই বাবা রত্নেশ এনে দিতেন। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী হবার কারনে তিনবছর বয়সেই সুমনকে কেজি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর চলে যায়। সুমন এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। প্রথম থেকেই সুমন ক্লাসে সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে। শিক্ষক শিক্ষিকারা এজন্য ওকে খুব ভালোবাসে। এইভাবে বেশ চলছিল।ক্লাস ফাইভে ওঠার পড়ে সুমনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে মা বৈশালী। সুমনের গলা কেমন মেয়েদের মতো আর হাবভাবটাও মেয়েলী স্বভাবের। দেখতে দেখতে ওর হাঁটাচলাও বদলে যেতে থাকে দেখে বাবা মাও চিন্তায় পড়ে যায়।ডাক্তার হবার কারণে রত্নেশ বুঝতে পারে হরমোনজনিত কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে সুমনের মধ্যে। এই নিয়ে হাসপাতালের সহকর্মী হরমোনের ডাক্তার ডা. জালানের সঙ্গে আলোচনা করলে ডাক্তার জালান সুমনকে নিয়ে আসতে বলেন। তার কথামতো রত্নেশ সুমনকে নিয়ে যান ডাঃ জালানের কাছে ।ডাঃ জালান সমস্তরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানিয়ে দেন এমনি কোনো শারীরিক সমস্যা নেই সুমনের তবে জিনগত কিছু সমস্যা আছে। ওকে কিছু বলার দরকার নেই ওকে ওর মতো চলতে দিতে হবে যাতে ছেলে কোনোরকম ভুল না বোঝে।
দিন চলতে থাকে, এর মধ্যে স্কুলেও অসুবিধার মধ্যে পড়ে সুমন। ওর মেয়েলি হাবভাব কথা এসব দেখে ওর বন্ধুরা ওকে খুব মজা করে। ছেলেদের স্কুল হবার কারণে ওদের সাথেই একসাথে পড়াশোনা করতেই হয় সুমনকে। কিন্তু ইদানিং সুমনের খুব অসুবিধা হচ্ছে সেটা ওর বাবা মা বুঝতে পারে। একদিন এই নিয়ে স্কুলেও হেডমাষ্টার ডেকে পাঠিয়ে নানান কথা বলেন যে ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ওর আচরন পুরো মেয়েদের মতো।তাই ওর প্রতি বাড়িতে যেন বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেইসঙ্গে ডাক্তার দেখিয়ে তার পরামর্শ মতো যেন তারা চলেন।
একদিন বন্ধুবান্ধবদের আচরণ নিয়েও সুমন বাবা মায়ের কাছে নালিশ জানায় কিন্তু বাবা মায়েরও এই ব্যপারে কিছু করার ছিল না শুধু দুশ্চিন্তা করা ছাড়া। একদিন স্কুলে সুমনকে ওর বন্ধুরা মজা করে ঠেলে ফেলে দিলে ওর পায়ে খুব লেগে গিয়ে রক্তপাত হয়।স্কুল থেকে ওর মায়ের কাছে খবর যায়। মা বৈশালী নিজের স্কুল থেকে ফেরার পথে সুমনের স্কুলে গিয়ে দেখে সুমনকে পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে টিচার্স রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে।সুমন মাকে দেখে করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকায়। বৈশালী লক্ষ্য করে সুমনের চোখের জল শুকিয়ে গালে কালো দাগ এঁকে দিয়েছে। সুমনের এই অসহায় অবস্থা দেখে বৈশালীর চোখে জল এসে যায়।ওর স্কুলের টিচার বলে 'আপনি একবার হেড স্যারের সাথে দেখা করে নিন দিদি', সুমনকে নিয়ে বৈশালী তখন হেড স্যারের কাছে যান, হেড স্যার বৈশালীকে দেখে বলেন 'আমি সব শুনেছি আসলে সব বাচ্চা এখানে কাকে কি বলি বলুন তো, সুমন এতো ভালো স্টুডেন্ট অথচ এই পরিস্থিতিতে ওর পক্ষে পড়াশোনা করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে,
- না না আপনি কুন্ঠিত হবেন না তাছাড়া আমি তো অন্য কোথাও যেতেও বলিনি,আসলে কি জানেন ম্যাডাম আপনার ছেলে খুব ভালো ছাত্র কিন্তু ওর মধ্যে অন্যরকম সমস্যা তৈরি হয়েছে সেটাকে সবাই মিলেই সমাধান করতে হবে নাহলে শিশুমনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে,, একটু থেমে হেড স্যার আবার বলেন- বরঞ্চ আমি ওর জন্য আলাদা বেঞ্চ দিয়ে বসার ব্যবস্থা করছি আপনারা শুধু সুমনকে ভালো করে বোঝান ও যেন অন্য কোনো কিছুর দিকে মন না দেয় শুধু যেন পড়াশোনা করে, বাকিটা আমি দেখছি
- কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো স্যার, আমি আর ওর বাবা আজকেই ওকে বোঝাবো আপনার কথামতো। ও আমাদের একমাত্র ছেলে, ওর জন্য যা করতে হয় করবো স্যার, আসি স্যার নমস্কার নেবেন,
- হ্যাঁ হ্যাঁ নমস্কার আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আমাদের পক্ষে যেটা করা সম্ভব সেটাই করবো, সুমনকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে বৈশালী। সন্ধ্যায় রত্নেশ এলে বৈশালী সবকিছু খুলে বলে। সব শুনে রত্নেশ বলে- সুমন যে যা বলে বলুক তুমি তোমার মতো পড়াশোনা করবে, কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না, কেউ কথা বললে বলবে নাহলে চুপচাপ থাকবে, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মনে থাকবে?
- হ্যাঁ বাবা আমি পড়ব শুধু, কারুর কথায় কিছু মনে করবো না, আমি কাউকে কিছু বলিনি বাবা, ওরা আমাকে ঠেলে ফেলে রক্ত বার করে দিয়েছে, আমার শুধু কান্না পেয়েছিল, কিন্তু কাউকে কিছু বলিনি বাবা,
- বাহ তুমি খুব ভালো এবং বুদ্ধিমান ছেলে তোমাকে অনেক দুর যেতে হবে, যাও এখন পড়তে বসো বাবা- কিছুটা ধরা গলায় বলে রত্নেশ,
সুমন চলে গেলে বৈশালী কেঁদে ফেলে সুমনের কথা ভেবে, রত্নেশ সান্তনা দিয়ে বলে এত চিন্তা কোরোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর থেকে স্কুলে আলাদাই বসে সুমন, একমনে পড়ে, শিক্ষক শিক্ষিকারা পড়া ধরলে সব উত্তর ঠিকঠাক মতোদেয়, এই জন্য সব শিক্ষক খুব খুশি সুমনের ভদ্র নম্র ব্যবহারের জন্যে।হেডস্যার অন্যান্য ছাত্রদের অভিভাবকদের ডেকে সব কিছু বলে দেবার পর সমস্যা অনেকটাই কেটে গেছে তাছাড়া হেড স্যার সুমনকে খুব পছন্দ করে ওর মেধার জন্য। বেশ কিছুদিন এভাবে কেটে গেছে। যথারীতি প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম হয়ে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সুমন, জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা তাই প্রস্তুতি নিচ্ছে সুমন, মা বাবা যখন যেমন পারে ওকে সাহায্য করে, একজন মাষ্টার রাখা হয়েছিল সুমনের জন্য কিন্তু স্বচ্ছন্দ বোধ না করার কারণে তাকে ছাড়িয়ে একজন মেয়েকে পড়ানোর জন্যে রাখা হয়েছিল তার কাছে পড়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করার কারণে সেই দিদিমনি রয়ে গেছে সুমনের।
সুমন ইদানিং বুঝতে পারে ওর মনের ভিতরে অদ্ভুত একটা অনুভুতি কাজ করছে।সবসময় নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে, একটা অন্যরকম লজ্জাবোধ কাজ করে ওর মধ্যে। ওর চোখ মুখেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। অদ্ভুত ভাবে ওর মুখে গোঁফ দাড়ির কোনো রেখা দেখা যায় না।মুখটা ওর খুব সুন্দর লাগে। একদিন বাড়িতে দুপুরবেলা পড়ছিল সুমন, হঠাৎ ওর শাড়ি পড়ার খুব ইচ্ছে হয়, সঙ্গে সঙ্গে আলমারি থেকে মায়ের একটা শাড়ি কোনোরকমে পড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজেকে আয়নায় দেখে ওর মনের মধ্যে একটা অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে।সেইসময় বৈশালী বাড়িতে স্কুলের খাতা দেখছিল, হঠাৎ তার মনে হয় যে দেখিতো সুমন পড়াশোনা ঠিক করছে কিনা, পরীক্ষার তো বাকি নেই বেশিদিন, সুমনের ঘরের দরজা আধখোলা ছিল বৈশালী ঢুকতে গিয়ে দেখতে পায় সুমন শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ওই অবস্থায় দেখে আর ঘরে ঢোকেনা বৈশালী, সুমনের দিকে একটু তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালো ভাবে পাশ করে সুমন জেলার মধ্যে প্রথম হয়,স্কুল থেকে বিশেষ ভাবে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় সুমনকে।এই প্রথম রত্নেশ আর বৈশালী চরম আনন্দ এবং স্বস্তি অনুভব করে। এরপরে অন্য একটা বড় স্কুলে ইলেভেনে ভর্তি হয় সুমন। ইতিমধ্যে বাবা রত্নেশ ঠিক করে ছেলেকে ডাক্তারিটাই পড়াবে, ওর ইচ্ছা ছেলে যেন ওর থেকেও বড় ডাক্তার হয়।মা বৈশালীরও একই ইচ্ছার কারণে সুমন ঠিক করে বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করবে, বাবা মায়ের ইচ্ছাটা ওরও একান্ত ইচ্ছা, ও ভাবে ওকে অনেক বড় ডাক্তার হতে হবে তার সঙ্গে...
ছোটবেলার স্কুলের মতো এখানে সেই সমস্যা নেই সুমনের। বরঞ্চ এখানে সবাই খুব ভালো বিশেষ করে সমরজিত তো আরো ভালো, ওর সঙ্গেই বেঞ্চ শেয়ার করে বসে সুমন। সুমনের খুব ভালো লাগে সমরজিতকে, আর সমরজিতও খুব পছন্দ করে সুমনকে। একসাথে গল্প করা, টিফিন খাওয়া, মজা করা, পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করা এসব নিয়ে খুব ভালোভাবেই দিন কাটে সুমনের। সমরজিতকে কোনোদিন না দেখলে মনের মধ্যে অন্যরকম একটা কষ্ট অনুভব করে সুমন।
সুমনের এখন ঘাড় অবধি লম্বা চুল, সেটাও পনিটেল করে বাঁধা, সবসময় জিন্স প্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা জামা পড়ে থাকে, দেখে কেউ বলবেইনা যে ও ছেলে, গলার স্বর সেই ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মতো, গোঁফ দাড়ির চিন্থ মাত্র নেই মুখে। দেখতেও সত্যি সুন্দর লাগে সুমনকে।ব্যক্তিত্ব এবং স্মার্টনেসে সুমন অনন্য।
সুমন বুঝতে পারে ও মনে মনে সমরজিতকে ভালোবেসে ফেলেছে,আর বুঝতে পারে সমরজিতও ওকেই পছন্দ করে তাই স্কুলে ওর সাথে ছাড়া কারোর সাথে থাকতে চায় না।
দেখতে দেখতে আরো বেশ কিছু দিন কেটে যায় এইভাবে। দেখতে দেখতে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা এসে যায়।সুমন পরীক্ষা দেবে বলে সমরজিত নিজেও জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তাছাড়া সুমনেরও খুব ইচ্ছা ছিল সমরজিত যেন পরীক্ষা দেয়।
একসময় জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাও হয়ে যায়, পরবর্তী কয়েকটা দিন সমরজিতের মোটরসাইকেলে করে ঘুরে বেড়ায় সুমন, এখন ও সমরজিত ছাড়া কারো কথা ভাবতে পারে না। সমরজিত ওদের বাড়ির নিচে এসে হর্ন দিলেই খুশিতে উচ্ছল হয়ে বেরিয়ে যায় সুমন।রত্নেশ বৈশালী সব বুঝতে পারে কিন্তু কোনোরকম বাঁধা দিতে পারেনা। তাছাড়া সমরজিত বেশ কয়েকবার এই বাড়িতেও এসেছে, সমরজিতকে ওদের বেশ ভালোই লাগে কেমন প্রাণোচ্ছল, মনের মধ্যে কোনো জড়তা নেই, ওদের দুটি বেশ হাসিখুশিতেই আছে দেখে ওরাও একপ্রকার সময়ের হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছে। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে প্রথম দশের মধ্যেই জায়গা পেয়ে। ডাক্তারিতেই সুযোগ পেয়ে যায় সুমন এছাড়া সমরজিতও ভালো রাঙ্ক করে ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়ে যায়। ওরা দুজনেই কলকাতার মেডিকেল কলেজে জায়গা পেয়ে একসাথে ভর্তি হয়। তারপর তো শুধুই সফলতার কাহিনী, এমবিবিএস পাশ করে দুজনেই এখন ডাক্তার। মেডিকেল কলেজেই দুজন ইন্টার্নশিপ করে। এর মধ্যে চুপিসাড়ে সুমন নিজের সত্বাকে প্রতিষ্ঠা দিতে কিছু শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে নিয়েছে। সেটাও সমরজিতকে সঙ্গে নিয়ে।তাতে ফলাফলটাও খুব চমকপ্রদ। যে ডাক্তারকে সুমন দেখিয়েছিল তার মতামত অনুযায়ী সুমনের শারীরিকভাবে রূপান্তরিত হবার ক্ষেত্রে কোনোরকম বাধা নেই কারণ সুমনের শারীরিক গঠন পুরোটাই নারীদের মতো এবং সেটা শরীরের প্রতিটা অঙ্গেই ফুটে উঠে নারীত্ব জানান দিচ্ছে, শুধু একটা অপারেশন করলেই সুমন আরেকটা নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারবে, ডাক্তারের কথা শুনে সুমনের আনন্দ বাঁধ মানতে চায় না, আর সমরজিত তো ওর এককাঠি ওপরে। খুব তাড়াতাড়ি ওরা দুজনেই এমডি কোর্সটা করে নেবে তারপর সেই বহু আকাঙ্খিত অপারেশনটা করিয়ে নেবে, ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সমরজিতের দিকে হাসিমুখে তাকায় সুমন আর সমরজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে ওর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ভীষনভাবেই অনুভব করে। মোটরসাইকেল স্টার্ট করে সমরজিত, সুমন পিছনে উঠে বসে জড়িয়ে ধরে সমরজিতকে, মোটরসাইকেল হাওয়ার বেগে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে রাস্তার বাঁকে।