বয়সের সাথে সাথে পড়ালেখা আর কর্মব্যস্ততার চাপ। বাইরের হাস্যোজ্জ্বল খোলসের অন্তরালে ক্লান্ত মনটা আর সেই রস দেয় না আগের মতো। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে রাতে ঘুমানোর আগে হৃদয়টা যেন স্বর্ণাভ ডানায় ভর দিয়ে, হরিদ্রা রোদ্দুর মাখা নীলাভ গগনে উঁড়তে মন চায়। কিন্তু ঐ যে এখনকার সময়টা মনকে বন্দী করে ব্যস্ততার পিছনে ঘোরার সময়। তবে মাঝে মাঝে মনকে একটু বিরতি দেওয়ায় উত্তম। যাইহোক মনের ক্লান্তিটা দূর করতে একটু প্রকৃতির মাঝে ডুব দেওয়া বা নিজেকে মেলে ধরার চিন্তা করলাম। বিষয়টা মুয়ায মামাকে জানালে মামাতো এক পায়ে খাঁড়া। তারপর বন্ধু আজিজুল, প্রান্ত, সাইমুন, মাহদীন, মেহমেদকে জানালে তারাও রাজি হলো। পরের দিন সবাই স্কুল মাঠে আসলাম, এবার গন্তব্যস্থান ও তারিখ ঠিক করার পালা। যেহেতু সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। সেহেতু আমি ভাবলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়া যাক। যদিও অতীতে কখনো এখানে যাওয়া হয়নি, পত্রিকাতে খবর দেখে টাঙ্গুয়ার হাওরের সাথে আমার পরিচয়। মুয়ায মামা বললো আমাদের ভ্রমণটা হবে ৪-৫ দিনের, না হলে জমবেনা! যদিও বছরের এই মাঝামাঝিতে এতদিন সময় ম্যানেজ করাও কঠিন, তবুও মুয়ায মামা ও আজিজুলের কারণে সবাইকে একমত হতে হইলো। আমি বললাম টাঙ্গুয়ার হাওর, মুয়ায মামা বললো রাতারগুল হাওর, মাহদীন ও মেহমেদ বললো পানথুমাই জলপ্রপাত। অবশেষে এই তিনটি স্থান মোটামুটি নির্দিষ্ট হলো।
আষাঢ়ের একদিনে বের হলাম।
আহহহ!
প্রশান্তি!
আমরা আমাদের জেলা সদর থেকে পরিবহনে উঠে সুনামগঞ্জ সদরে পৌঁছালাম। তারপর একটা হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে রাতযাপন করে সকালে ব্রেকফাস্ট করেই রওনা দিলাম টাঙ্গুয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনা খাবার ও পানি ব্যাগে ভরে নিলাম। তারপরে এক সিএনজি নিয়ে ১ ঘন্টায় চলে গেলাম মনোমুগ্ধকর তাহিরপুরে। তাহিরপুর থেকে ছোট নৌকা ভাড়া করে যাত্রা করলাম গন্তব্যস্থল টাঙ্গুয়ার হাওরে। রাস্তার দু’পাশ দিয়ে জলাশয়ে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। মনের শান্তিতে নৌকা বেয়ে যাচ্ছে মাঝি ও জেলেরা। এগুলো দেখে মনে পড়লো ঐ যে আমি আমার “বাংলার রুপ” কবিতায় লিখেছিলাম –
“ডিঙ্গি খেয়া বেয়ে তরঙ্গিনীর বক্ষ মাড়িয়ে
সলিলে জাল, অপেক্ষমান, মৎস্য শিকারে,
উতলা মনে বৈঠা হাতে গুনগুনিয়ে গানের তালে
ললাটের ভাঁজে খুশি, ভরছে সিকি, প্রফূল্লতায় জেলে।”
চলে আসলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে।
বাহ!
পুরো মনমাতানো।
তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। প্রথমে এসে পৌঁছালাম ওয়াচ টাওয়ারে। মনের মধ্যে সেই প্রতীক্ষিত উন্মোদনা বয়ে চলছে। এখানে পানি কখনো আকাশের মতো নীল আবার কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ। এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটুম্বর টাঙ্গুয়ার হাওর। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, বিভিন্ন পাখির গুনগুনানি এবং করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে এখানে। সৌন্দর্যবর্ধন জলাবন দেখতে দেখতে চলে গেলাম হাওরের মাঝখানের দিকে। তারপর দিগন্তজোড়া জলরাশি দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেলো। আমরা নৌকাতে নামাজ আদায় করে নিয়ে হালকা লাঞ্চ শেষ করলাম। আম্মু-আব্বু ছাড়া এই প্রথমবার আমার একা দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। মনে আধ-একটু ভয় কিন্তু রয়েই যায়! একা বাইরের বের হওয়াতে নিজের মধ্যে যেন অন্যরকম অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হচ্ছে। একটা কথা মনে পড়ছিলো তখন, “আর-রিহলাহ ফি তালাব আল ইলম” অর্থাৎ “সফর করলে জ্ঞান বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।” এরপর আমাদের নৌকা চলতে শুরু করলো টেকেরঘাটের দিকে। নৌকা যতোই চলে ততোই আমরা স্বচ্ছ পানি দেখতে পাই। এমনকি হাওরের তলা পর্যন্ত দেখতে পেয়ে চমকে উঠি। এখানে দেখা মেলে পানকৌড়ি, ডাহুক, গাঙচিল, বক, শঙ্খ চিল, কাক, ভুঁতিহাস, পাতিহাস, নীলশিরসহ হরেক ধরণের পাখি এবং কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, লালবুক গুরগুরি, ইয়ার, পাতি লালপা, মাছমুরাল, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, গেওরাল বাটান,বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দিসহ অনেক ধরণের বিরল প্রজাতির পাখি। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার সাপ এবং প্রাণী রয়েছে। এখানকার এই অপরুপার জন্য এই হাওরকে মাদার অব ফিশারিজ বলা হয়।
তারপর ধীরে ধীরে নৌকা বেয়ে চলে আসলাম টেকেরঘাটের নীলাদ্রি লেকে। এটি শহীদ সিরাজ লেক নামেও পরিচিত।আবার এই লেককে পাথর কেয়ারি নামেও ডাকা হয়। এখানে আমরা রাত নৌকাতে রাত কাটাবো ভাবলাম। এখানকার পানি নীল রঙের মতো দেখায়। ছোট ছোট টিলা এবং পাহাড়ের জন্য এই লেককে করেছে অসম্ভব সৌন্দর্যের অধিকারী। এই শোভাময় দৃশ্যের জন্য নিলাদ্রী লেক বাংলার কাশ্মীর উপাধি পেয়েছে। নয়ন জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্যসমূহ দেখে বার বার মনে পড়ে পবিত্র কুরআন মাজিদের সূরা আর-রহমানের একটি প্রসিদ্ধ আয়াত, “ফাবি আইয়ি আলা ইরাব্বিকু মা তুকাজ্জিবান” অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে!” নীলাদ্রি লেক থেকে সবাই পানিতে হৈ হুড়- লাফালাফি করে গোসল করে উঠলাম। তারপর সূর্য মামা পশ্চিম গগনে অস্ত নেমে সন্ধ্যা গড়ালো। লেকে পর্যটকদের নৌকা থেকে আসা আলো, আকাশে তারা ও পূর্ণিমার চাঁদ দেখে পুরো রাতটাও আনন্দে কেটে গেলো। আমরা নৌকা বসে সবাই বিভিন্ন বিষয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা, হামদ-নাত, কাগজ দিয়ে ছোট বেলার চোর পুলিশ খেলাটাও করলাম। সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো আমরা সবাই মিলে একসাথে পবিত্র কুরআন মাজিদ পাঠ করার সময়। যেন মনে হয়েছিলো গাছ-গাছালি,পাখ-পাখালী,হাওরের পানি, আকাশের মেঘ সরিয়ে উঁকি দেওয়া তারকারাজি ও চাঁদ আমাদেরকে সঙ্গী হয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনতেছে এবং আমাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমাদের নৌকায় ছাউনি দিয়ে রুম মতো বানানো ছিলো ফলে রাতে নৌকার ভিতরে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমাতে পারলাম। নৌকাতে সোলার প্যানেল থাকায় আলোকিত ছিলো, সেই সাথে বাথরুমও ছিলো, পুরো অসাধারণ! এশার নামাজ পড়ে ডিনার করে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে আমরা যাদুকাটা ও বারিক্কাটিলা দেখতে গেলাম।
যাদুকাটায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যে সারি সারি উঁচু কিংবা নিচু পাহাড় ও বারিক্কাটিলার বুকে ঘন সবুজের সমারোহ আমাদেরকে আকর্ষণ বাড়িয়েছিলো। দুপুরের দিকে ওখান থেকে টেকেরঘাটে ফিরে আসলাম। গোসল করে, লাঞ্চ করে একটু রেস্ট নিয়ে একটি হাওর ঘুরে তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সন্ধ্যার আগেই আমরা তাহিরপুরে এসে পৌঁছায়। তারপর আমরা সিএনজিতে করে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। সুনামগঞ্জ জেলা সদরে এসে হোটেলে এসে রাতযাপন করি। এটা ছিলো সুনামগঞ্জ জেলায় দুইদিনের সফর। আসলেই নির্দিষ্ট ভূখন্ড থেকে বের না হলে মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগতের অনেক কিছুই অজানা রয়ে যায়। প্রকৃতি দর্শনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি চিন্তাশীলদের চিন্তার খোরাকও মেটায়।
পরদিন সকালে উঠে আমরা রওনা দেই সিলেটের উদ্দেশ্যে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে সিলেটে পৌঁছালাম। তারপর সিলেটের অপূর্ব প্রকৃতি দেখতে দেখতে চলে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত “সিলেটের সুন্দরবন” খ্যাত রাতারগুলে। এটি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। রাতারগুলে পৌঁছায়ে মুয়ায মামা এখানকার বিট অফিস থেকে ফি দিয়ে ভ্রমনের অনুমতি নিয়ে নিলেন। তারপর আমরা একটি ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। এতো সুন্দর! নয়নাভিরাম দৃশ্য। জঙ্গলে যেয়ে দেখা মিললো, বাজপাখি,
বক,কানিবক,টিয়া,বুলবুলি,মাছরাঙা,ঘুঘু,পানকৌড়ি,চিলসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্য প্রাণী। বেত,কদম,মুর্তা,পিঠালি, কদম,হাতিম,বট,অর্জুন সহ হরেক রকমের গাছ-গাছালী। এখানে বিভিন্ন রকমের মাছও পাওয়া যায়। গাছের ফাঁকে ফাঁকে কখনো রোদেরা খেলা করে,কখনো আবার আকাশে মেঘের খেলা জমে। ঘন সবুজের মাঝে শীতল পবন এসে ছুঁয়ে যায় আমাদেরকে। এটা যেন প্রকৃতির রাজ্য।
নৌকায় চড়ে সবাই মিলে সারাদিন বনের ভিতরে ঘুরলাম। প্রকৃতির রুপসুধা নিজের চোখে দেখে দেখে সত্যিই মনটা ভরে গেলো। যতই ভিতরে যাচ্ছি ততোই মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। সেই সাথে নানান এলাকার নানান মানুষ ভিন্ন রকমের ভাষাও যেন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো। পুরো তিনদিন প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিলাম। এক মিষ্টি অনু্ূভূতি বিরাজমান। প্রকৃতি দিয়েছে অসীম ভালোবাসার ছোঁয়া। নিজেকে প্রশ্ন করি, কেনো এতদিন এই সুন্দর মুহুর্তগুলো থেকে ও সুশ্রী সুদর্শন পর্যটন স্থান গুলো দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখছিলাম! মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার এই বিশাল সৃষ্টিকে দর্শনের মাধ্যমেও জ্ঞান আহরণ ও আত্মশুদ্ধি করা যায়। ভ্রমনের মাধ্যমে শরীর ও মন ভালো থাকে,দেহে চঞ্চলতা অর্জিত হয়। পবিত্র কুরআন মাজিদের সূরা আন”আমের ১১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমার পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো,অতঃপর দেখো,যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে,তাদের পরিণাম কি হয়েছিলো?” ভ্রমণের মাধ্যমে নানা বৈচিত্রময় দৃশ্য অবলোকন করে জীবনকে সুন্দর ও সহজ ভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। সন্ধ্যার আগে আমরা বিশ্বের এই অন্যতম জলাবন রাতারগুল ত্যাগ করে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হই। হোটেলে এসে বুক ভরা আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এবার নেক্সট টার্গেট পানথুমাই জলপ্রপাত।
সকালে উঠে আমরা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বের হলাম পানথুমাইয়ের পথে। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় এটি অবস্থিত। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপাশে ভারতে বিশাল ঝর্ণা রয়েছে,যেটা বাংলাদেশের পানথুমাই গ্রাম থেকে দেখা যায়। এই ঝর্ণাকে কেউ কেউ বড়হিল ঝর্ণা ও ফাটাছড়ির ঝর্ণা বলেও ডাকে। ঝর্ণাটি সীমান্তের ওপারে হলেও বাংলাদেশের সীমান্তের পাশ থেকে খুব সুন্দর ভাবেই দেখা যায়। শাঁ শাঁ শব্দে কয়েক শত ফুট উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসছে শুভ্র জলধারা। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলরাশিকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কেউ বিছিয়ে রেখেছে সাদা শাড়ী। কাছে গেলে ঝর্ণার শব্দে মনের ঘোর কাটলো। বিমুগ্ধ হয়ে কিছু সময় পাহাড় আর জলের এই মিতালির দিকে চেয়ে রইলাম। ঝর্ণাধারা দিয়ে নেমে আসা শীতল পানিতে সবাই মিলে গোসল করে নিলাম।
মনে মনে প্রশ্ন জেগেছিলো যে, “আমি কে? মহান আল্লাহ কেনো আমাকে এতো সুগঠিত করে তৈরি করে এই সুন্দর ধরনীতে পাঠালো?” ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে যদি এত সৌন্দর্যমন্ডিত প্রাকৃতিক দৃশ্য থাকে তাহলে পরকালের জান্নাত কত সুন্দর হবে! আর সেই জান্নাত তো হবে অনন্তকালের জন্য। আমাদের ছোট্ট এই দেশে এত সুন্দর সুন্দর আঁখি জুড়ানো দৃশ্য থাকলে সমগ্র বিশ্বে কতই না এর চেয়ে শতগুন সুন্দর দৃশ্য রয়েছে! যাইহোক, এইসব ভাবতে ভাবতে নয়নজুড়ে উপভোগ করলাম পানথুমাই জলপ্রপাতের রূপ-লাবণ্য। আসরের পরপরই আমরা পানথুমাই ত্যাগ করে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সিলেটে এসে হোটেলে রাত কাটালাম। পরেরদিন আমরা সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পুরো জার্নি-ঘোরাঘুরিটা ছিলো মন মাতানো। সবাই পুরো রিফ্রেশ হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে একটু ট্যুর দিলে হৃদয়, শরীর রিফ্রেশ থাকে, ফলে সুস্থতা উপভোগ করা যায়। সত্যিই একজন ভ্রমণকারীর জন্য তার প্রতিটি ভ্রমণের স্মৃতি একটি মূল্যবান উপহারের মতো।