এস এম নওশের
মফস্বলের একটা সাহিত্য সভা করে ফিরছিল অনিমেষ। এ সমস্ত প্রগ্রাম গুলায় এরা বেশ ভাল সম্মান করে। অনিমেষ একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। বই মেলায় বেশ কটা বই বেরিয়েছে তার। ভালই বিক্রি হয়েছে। পাশা পাশি কিছু দৈনিকে ও নিয়মিত লিখছে। আবার অনলাইন পত্রিকা আর লিটল ম্যাগাজিন গুলাতেও তার লেখা যাচ্ছে। কিছু পত্রিকার ঈদ সংখ্যাগুলা তেও তার প্রতিবছর ই যায়। এর মাঝে কিছু পুরস্কার ও এসে গেছে তার ঝুলিতে। তার দুটো উপন্যাস নিয়ে টিভি নাটক হয়ে গেছে এর মধ্যেই পাশাপাশি ভাল একটা চাকরি ও করে মাল্টি ন্যাশনাল ব্যাংকে। আসলে সব লেখকদের ই একটা বিকল্প আয়ের উতস থাকতে হয়। তা না হলে হতে হয় হাভাতে লেখক। তারা হয় প্রকাশক কিম্বা পত্রিকা সমপাদকদের চাকর বাকর। তারা যেভাবে যা ডিমান্ড করবে সেভাবেই লেখা হাজির করতে হয় তাদের টেবিলে। অনিমেষের সেই চিন্তা নেই। প্রকাশকদের কথায় সে কখনোই উঠ বস করেনা।তার লেখার নিজস্ব চিন্তা একটা ধারা আছে।যার সাথে সে কখনোই কম্প্রোমাইজ করেনি। এই তো কিছুদিন আগেই এক নাম করা প্রকাশক তাকে চা খেতে ডেকে বললেন সমকামি তা আজকাল খুব খাচ্ছে।এর উপরে একটা উপন্যাস করে ফেলুন। এই বই মেলাতেই আনব ভাবছি বইটা। এখন এক লাখ টাকার একটা চেক দিয়ে দেই। পরে চুক্তি ফুক্তি যা হয় করা যাবে। আপনি আদাজল খেতে লিখতে বসে যান। কোন জবাব না দিয়ে চলে এসেছিল। কারন যে যাই বলুক এই বিষয়টা তার কাছে মোটেই পছন্দনিয় নয়।যে সাব্জেক্ট তার পছন্দ না সেই সাব্জেক্ট এর উপরে লেখা তার পক্ষে অসম্ভব। সে তো লিখে কেবল লেখার আনন্দে। তার সংসার লেখা লেখির আয় দিয়ে চলে না। ফরমাইশি লেখা তার একেবারেই অপছন্দ। লেখা লেখি হল ওর কাছে নিছক প্যাশন। কখনোই একে প্রফেশন করার চিন্তা করেনি। আজকের সাহিত্য সভা টা ছিল লাকসামে। সেখানে চট্টগ্রামের একজন প্রবীন কবি আর ও ছিল সভাপতি আর বিশেষ অতিথি। এরা নবীন লেখকদের উতসাহ দিতে তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন করে অনলাইনে। তারপর বাছাই করে কিছু কবি লেখক দের ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট দেয়। তাদের উদ্দেশ্যে ও কেবল একটা কথাই বলে লিখবে শুধুই লেখবার আনন্দের জন্যে। নিজের সৃজনশীলতার উপর আস্থা হারালে চলবেনা। সভা শেষ হবার পর সন্ধ্যায় আয়োজকেরা ওকে ঢাকা গামি ট্রেনের ফাস্ট ক্লাসে তুলে দেয়। ট্রেনে কেবল একজন ই সহযাত্রী। তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। বুকের হার্টবিট বেড়ে গেল যেমন টা কুড়ি বছর আগে কলেজের করিডোরে বেড়ে যেত মাধবিলতা কে দেখলে। সেই মাধবিলতার মুখোমুখি আজ সে।
কেমন আছো? শুরু করল মাধবি নিজেই
চি চিনতে পেরেছ? অনিমেষ একটু নার্ভাস। ঠিক যেমন টা ফিল হত সেই কুড়ি বছর আগে মাধবি কে দেখলে। বুকের ভেতরে হার্টবিট যেন ট্রেনের স্পীডের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।
হাসলো মাধবি। সেই মিস্টি হাসিটা এখনও অম্লান
তুমি এখনো আগের মতই আমাকে দেখলে নার্ভাস হয়ে যাও।
ন না। আ আসলে অনেক বছর পর দেখা তো। চমকে গেছিলাম। ঢোক গিলল অনিমেষ। গলাটা ভীষণ শুকিয়ে আসছে।ব্যাগ থেকে পানির বোতল টা বের করল।
নিশ্চই আমাকে এক্সপেক্ট করোনি। ঠোটের কোনে চাপা দুস্টু হাসি মাধবির কোন জবাব দিলনা অনিমেষ।
তুমি তো বেশ ভালই লেখো টেখো দেখি। ফেসবুকে আর পেপারে দেখি তোমার লেখা।
অনিমেষ মনে মনে গর্বিত বোধ করলেও মুখে বলল এই হালকা পাতলা লিখি আর কি। অফিসে কাজের চাপে সময় পাই কই? অনিমেষ যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় প্রথম। ক্লাসের দিন ই দেখে মাধবি লতা কে। দেখেই তার ভেতরে হ্রদ কম্প বেড়ে যায়। কোথায় যেন পড়েছিল মানুষ যখন প্রথম দেখাতেই কারো প্রেমে পড়ে যায় তখন নাকি তার এমন হয়। অনিমেষ বরাবর ই চাপা স্বভাবের। ফলে নিজের ফ্রেন্ড সার্কেল তেমন একটা ছিলনা। নিজের মতই থাকত। মাধবিলতা ছিল পুরোই উলটো। তুখড় ছাত্রী। আবার ভাল তার্কিক। সেই সাথে ভাল এথলেট। রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিল। অনিমেষ দূর থেকে অবাক হয়ে ভাবত মেয়েটা এত কিছু করার সময় পায় কি করে। ওর যা ভালো লাগা ভালোবাসা সব দূর থেকেই। যদি বা কখনো দৈবাত মাধবি ওর কাছে আসতো কোন কাজে সে নার্ভাস হয়ে তোতলাতে শুরু করত। নিজেকে কখনোই ওর যোগ্য ভাবেনি। মনের কথা মনেই চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ঢাকায় চলে এলো। তারপর শুরু হল টিকে থাকার লড়াই।
বিয়ে তো করেছ?? মাধবি ই আবার শুরু করল কথা
হা হ হ্যা।
বউ কি অনেক সুন্দরি?
ক্কি কি জানি লজ্জা পেল অনিমেষ।
বাবু কয় টা?
এ এক ছেলে আর এক মেয়ে
বাহ সুন্দর সংসার তোমার।তোমার বউ বুঝি অনেক ভালোবাসে তোমায়??
অনিমেষ নিরুত্তর।
দুজনেই চুপচাপ অনেক ক্ষন
তো -তো তোমার কথা বল। নীরবতা ভাংলো অনিমেষ।
আমি। এই দেখছ। যেমন আছি।
তোমার হাসব্যান্ড বাচ্চা এরা কেমন আছে?? এতক্ষনে তোতলামি টা সরে সহজ হতে শুরু করেছে।
নেই। দীর্ঘশ্বাস মাধবির
মানে?
কেউ নেই।
অনিমেষ বিস্মিত।
আসলে আমার একটা বাচ্চা জন্মাবার পরেই মারা যায়। স্বামির সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে পাচ বছর।
দাত দিয়ে ঠোট কে চেপে বলল মাধবি।
আহা! ভেরি সরি।
না না ইটস অকে।
আচ্ছা তুমি তো আমাকে ভালো বাসতে।কোন দিন প্রপোজ করোনি কেন??
মাধবির এই প্রশ্নে চমকে গেল। এরকম প্রশ্ন সে আশা করেনি। বিস্মিত চোখে তাকালো
মৃদু হেসে বলল আমরা মেয়েরা ছেলেদের মনের কথা বুঝতে পারি।এটা আমাদের একটা এক্সট্রা ক্ষমতা। এমন কি কার মনে কি ইন্টেনশন কাজ করে এটাও বুঝি আমরা।
তুমি প্রপোজ করলে হয়ত আমার জ্যিবন টা অন্য রকম হত।
আসলে আমি। কখনোই নিজেকে তোমার যোগ্য ভাবিনি।
আসলে কে যে যোগ্য আর কে যে অযোগ্য জীবনের মোড়ে কিছুই বোঝা যায় না।
আমার সাবেক স্বামী আজ ঋনের দায়ে জেলে। আমার বাবা মা তো বড় ঘর বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত হ্যান্ডসাম ছেলে দেখেই বিয়ে দিয়েছিল। লাভ কি হল?? সে বিভিন্ন বাজে অভ্যাস ছিল। বিদেশ ট্যুরে যেয়ে বিভিন্ন বিদেশি মেয়েদের সাথে রিলেশন করে বাজে অসুখ এনে আমাকেও ইনফেক্ট করেছে। জানো আজ অর কারনে আমি এইচ আই ভি ক্যারিয়ার।
বজ্রাহত হয়ে গেল অনিমেষ
বল কি?
হুম এটাই সত্যি। আমেরিকা যেয়ে যেয়ে ট্রিটমেন্ট নিতে হয় আমায়। পরশু ফ্লাইটে যাচ্ছি আবার।
অনিমেষের ভীষন মায়া লাগল।
এরপর মাধবি নিজেই শুরু করল গল্প। ক্যাম্পাসের গল্প। পুরোনো বন্ধু আর স্যার ম্যাডাম দের গল্প। কিভাবে যে সময় চলে গেল টের ই পাওয়া গেল না
ঢাকায় কমলাপুর স্টেশনে নামার পর মাধবি বলল চলি। বেচে থাকলে দেখা হবে।
চলো গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
লাগবেনা বন্ধু।
একটু দাড়াও। এটা নিয়ে যাও। অনিমেষের হাতে আয়োজকদের দেয়া এক গুচ্ছ রজনি গন্ধা ছিল। সেটা মাধবির হাতে দিল।
অমা তুমি জানো কি করে রজনীগন্ধা আমার খুব ফেভারিট।
স্টিকের তোড়া টা নিয়ে লম্বা করে ফুল গিলোর ঘ্রান নিল। মাধবি লতা
হাসল অনিমেষ।
স্টিক গুলো বেশ তরতাজা আছে। আমি স্টেটসে যাবার সময়েও এগুলা নিয়ে যাব তোমার স্মৃতি হিসেবে।চলি ভালো থেকো।
মাধবি লতা চলে গেল। সেই দৃপ্ত ভংগিমায় হাটা পেছন থেকে বিমুগ্ধ হয়ে দেখল অনিমেষ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আব্দুর রহমান
লেখা পাঠানোর ইমেইল: sahityapata24@gmail.com