প্রথম প্রথম কথাটায় তেমন গুরুত্ব ছিল না। যাদের সে বলেছিল তাদের কাছে, এমনকি নিজের কথার গুরুত্ব তার নিজের কাছেও ছিল না। ভেবেছে একটা দেখা, আর পাঁচটা স্বপ্নেরই মতো। সে-ই তো কত দিন আগে একবার এসেছিল মা। হাঁটতে হাঁটতে মা মিলিয়ে যাচ্ছিল শীতের দুপুরে, মাঠের ওদিকে। সেই স্বপ্নে মায়ের বয়স কত কম! অতসী দিবাকরের কাছে মায়ের কথা বলেনি। ছেলেমেয়েদের কাছেও নয়। চলতে চলতে পথে বা ভিড়ের মাঝে মায়ের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। মা হারিয়ে গিয়েছিল কাওখালি থেকে পিরোজপুর, নদীর ঘাট পেরিয়ে মামাবাড়ি থেকে ফিরে আসার পথে। স্টিমারঘাটের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া। সেসব অতসীর কাছে গল্পের মতো। আগের জন্মের স্মৃতি প্রায়। দিবাকরের কাজের জায়গা বনগাঁয়। ট্রেনে যাতায়াত। সপ্তাহে ছ-দিন বামনগাছি থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছানো। সন্ধের পর অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ট্রেনে বনগাঁ থেকে ফিরে আসা। বামনগাছি স্টেশন থেকে যশোর রোডের দিকে মিনিট কুড়ির হাঁটায় নতুন-পল্লী। বনগাঁর যে বড় মিষ্টির দোকানটায় দিবাকর কারিগর কাজ করে, তাদের কাছে শনিবার ছুটি। ওইদিন সংসারের টুকটাক কাজ আর ছোট ঘরটুকুর ওপর টিনের চালের তদারক করে দিবাকর। তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছোঁবে। অতসী তার চেয়ে বছর সাত-আটের ছোট। ক-বছর আগে মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে তারা। রানাঘাটে। শুধু মিষ্টির দোকানের কাজে সংসার চলে না। দিবাকর ঘর লাগোয়া জমিটুকুতে শীতে সবজি ফলায়। অতসীর পোষা দেশি মুরগি আছে কটা। শনিবার সন্ধেয় স্টেশনে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে দিবাকর ডিম বিক্রি করে আসে। মাসে একদিন হয়তো অল্প কিছু সবজি বেচতে পারল দত্তপুকুর হাটে। সংসার আর ক্লাস এইটে পড়া ছেলের জন্য যেটুকু খরচ, এসবে তার মোটামুটি চলে যায়। এসব চেনা-অচেনা ছবির ভেতর স্বপ্ন এসে হাজির হয় একদিন। সেই স্বপ্ন আসে ঘুরেফিরে। শীতের শেষ দিকে নতুন পল্লীর মাঠের ওপাশে একমাত্র শিমুল গাছটা পাতা ঝরিয়ে এলোমেলো দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁদর-খেলা দেখানোর লোকটা মুলুক থেকে ফিরে আসে বছর বছর। তেমন একসময় অতসী একদিন বলে, আমি দেশে ফেরত যাবৃ। সন্ধের স্টেশন থেকে হাঁটাপথে ঘরে ফিরেছে দিবাকর। কাপড়ের থলেটা সে অন্যদিনের মতো দরজার কোনায় ঝোলায়। বলে, কোন দেশে? খানিক গম্ভীর দেখায় অতসীকে সেদিন। গোলচে তেলতেলে মুখে যেন অন্যমনস্কতা। বলে, গৌরনদী। দিবাকর কোনো কথা বলে না। সে জামা-প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে বাইরের কলতলায় যায়। গৌরনদী দিবাকরের অতসীর মুখেই কখনো শোনা। নদী নয়, নদীর ধারে কোনো গঞ্জের নাম। অতসীর সঙ্গে তার সংসার প্রায় বছর-পঁচিশের। অতসীদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় মারফত দুই পরিবারে যোগাযোগ হয়েছিল। দিবাকরের বাবা-মা তখন বেঁচে। বর্ডার পার হয়ে আত্মীয়বাড়িতে এসে থাকা মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছিল দিবাকরের বাবা-মায়ের। সেই থেকে সময়ের টানে-টানে দিবাকরের কাছে উঠে এসেছে অচেনা কিছু জায়গার নাম। গৌরনদী, গৈলা, টেকের হাট এবং অতসীর কিছু শৈশব-স্মৃতি, যা কখনো তার কছে খুশির, তবে বেশিটাই সময়ের পলিতে তলিয়ে যাওয়া। সংসার, ছেলেমেয়ে সামলে অতসীর শৈশব শব্দেরা স্মৃতি হয়েও যেন আর টেকে নেই। তবু এতদিন পরে গৌরনদী এবং সেখানে ফেরত যাওয়ার বাসনা। অতসীর স্বপ্নের আগামাথা খুঁজতে গিয়ে খাওয়ার পর দিবাকর অঘোরে ঘুমায়। প্রায় তিরিশ বছর হলো অতসী ঠাঁই-নাড়া। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। দিবাকর অবশ্য জন্মগতভাবে এদেশেন। তবু সে জেনেছে এবং বোঝে, অতসীর অতীত ছিল একটা, পুরনো ছবি ফিকে হওয়ার পরও দেয়ালে যেভাবে কাত হয়ে ঝোলে, খানিক সেরকম। কিন্তু অতীত টিকে থাকলেই কি তার কাছে ফিরতে হয়! নাকি পৌঁছানো যায় সেখানে! অতসী আবার একদিন যাওয়ার কথা বললে দিবাকর রানাঘাটে মেয়ের কাছে ফোন করে। এমন কী ক্লাস এইটে পড়া ছেলেকেও জানায়। রানাঘাট থেকে মণিকা বলে, মাকে তুমি ভালো করে বোঝাও বাবা। মা যেই সব নাম বলে সেসব আমরা চিনি না। মা কোথায় যাবে কার কাছে গিয়ে থাকবে? নতুন পল্লীর বাড়িটি বেড়ার, ওপরে টিন। কারো কারো বাড়িতে তিন ইঞ্চি দেয়ালের মাথায় টালি। বছর দশ-পনেরো আগেও চাষের মাঠ ছিল এসব। এখন চাষের জমি দূরের দিকে সরে গেছে। পাড়ার ভেতরে এখন ঢালাই ইটের রাস্তা। এখানে-ওখানে দু-একটা গাছ। পঞ্চায়েতের সামনে যে জলের ট্যাঙ্ক উঠেছে তা থেকে আসা নলে তিন রাস্তার মোড়ে সকাল-বিকেল টানা জল পড়ে। প্লাস্টিকের বালতির লাইন জমে মেয়েদের। অতসীর থেকে বয়সে খানিক বড় নয়নের মা। সে বালতি বসিয়ে জলের ধারার দিকে চেয়ে বলে, ওসব যাওয়ার কথা, দেশের কথা এখন মনে আনাও ভালো না। আজকাল কত রকম ফন্দি, কথা পাঁচ কান হলে সবার বিপদ হতে পারে। অসুখ বাড়ার মতো অতসীর অবশ্য অন্যমনস্ক ভাব বেড়ে যায়। পুরনো দেশ পেছনের জায়গা ছেড়ে আসা তার মনে হয় বেশিদিনের নয়। তাছাড়া কতজন তো জোর করেই আড়াল করে তাদের ফেলে আসা অতীত। আগের পরিচয়। জীবনের সবটাই যেন এখানে, সবই যেন এদেশে। দিবাকর ফোনে মেয়েকে খবর দেওয়ার পরও বিরক্ত হয়ে থাকে। অতসীকে বলে, আমরা কিন্তু কেউ তোমারে সঙ্গ দিতে পারব না। মেয়ের সংসার, আমার কাজ, সামনে ছেলের পরীক্ষা। পাসপোর্ট, ভিসা, বর্ডারের ঝামেলা, কে করবে অতসব! অতসী এক সকালে দিবাকর বেরোনোর আগে উঠোনের টানানো দড়িতে কাপড় মেলছিল। বলে, আমার আবার পাসপোর্ট কী! তাছাড়া বর্ডারে আর গৌরনদী বাজারে মনসা-মন্দিরের লোক থাকবে আমার জন্য। পাড়ার গলির মুখটার যেখানে শুরু সেখানে মুদিখানার দোকানের পাশে বিকেলে একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বসেন। চুন লাগানো ইটের দেয়াল, মাথায় টিন দেওয়া ছোট্ট চেম্বার। নতুন পল্লী আর সেই সঙ্গে দু-চারটে পাড়ার সর্দি-জ্বর-পেট খারাপের দরকার মেটে সেখানে। মাঝবয়সী রোগা ডাক্তারবাবু অতসীর প্রেসার মেপে আর চোখের কোল টেনে দেখে তিন পুরিয়া ওষুধ দিয়েছিলেন। পরপর তিনদিন সকালে খালি পেটে। বলেছিলেন, পেট গরমের অসুখ। এমন রোগী নাকি প্রায়ই আসছে আজকাল। সেই বিকেলে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য রানাঘাট থেকে মণিকাও চলে এসেছিল। শনিবার দিবাকরের হপ্তার ছুটি। ডাক্তারবাবুর হাত থেকে ওষুধ নেওয়ার সময় দিবাকর বলে, সেসব রোগী কি গৌরনদী বা টেকের হাট যেতে চায়? ডাক্তারবাবুর ভিজিট ষাট টাকা। বলেন, সবার তো পেছনের দিকে গৌরনদী নেই। বেশির ভাগেরই যা থাকে তা হলো, পেছনের সম্পর্ক। বিয়ে-সংসার সব হয়ে যাওয়ার পর পেট-গরম থেকে সে-সব সম্পর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে আপনাদের কেস আলাদা। দুদিন মায়ের কাছে থেকে মণিকা রানাঘাটে ফিরে যায়। দিবাকর হাতে থলে ঝুলিয়ে লোকাল ট্রেনে বনগাঁ যাতায়াত শুরু করে। পরপর তিনদিনের সকালের ওষুধ শেষ হয়। সন্ধেবেলা দিবাকর ফিরলে অতসী একদিন বলে, গৌরনদী যেতে চাওয়াটা সত্যিই কি কোনো অসুখ! দিবাকর খানিক বিভ্রান্ত। যদিও বাইরে সে উদাস ভাব দেখায়। বলে, ডাক্তার তো অসুখ বলেননি। বলেছেন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। অতসী এটা-ওটা হাতের কাজ সারে। পাশের ঘরে এইটে পড়া ছেলে দুলে দুলে টিউশনের পড়া মুখস্থ করে। অতসী বলে, গৌরনদী ঠিক না, ওইটা বাস-রাস্তার মোড়। ওখানে নেমে হেঁটে যেতে হয় পয়সার হাট, তারপরে গৈলা। আমাদের গ্রাম। আমাদের উঠোনে কত বড় মনসা-মন্দির তা এদিকে কেউ জানে না। দিবাকর ভাবে, তাহলে কি বারাসাত হাসপাতালের মানসিক আউটডোরে নিয়ে যেতে হবে একদিন! সে তো আবার বুধবার। কাজ কামাই হবে। নাকি কদিন দেখে আবার যাবে গলির মুখের হোমিওপ্যাথ চেম্বারে! সকালে বেরোনোর মুখে দু-বাড়ি পরের নয়নের মায়ের সঙ্গে আবার দেখা হয়। নয়নের মা জল নিতে এসেছিল। দিবাকরকে দেখে বলে, অতসীর বাপের বাড়ি আর আমার মামাদের বাড়ি ছিল কাছাকাছি। তিন-চার মাস ধরে ও যে কথা-কটা বলছে তা ভুল কিছু নয়। তবে এখন ইন্ডিয়ায় এসে আধার-ভোটার সব হয়ে যাওয়ার পর অত কিছু না মনে রাখাই ভালো। তুমি উড়ে বোঝাও। দিবাকর বলে, বোঝানোর জায়গা কি আর আছে দিদি! ডাক্তারের ওষুধ ফেল। তার তো দিনে-রাতে এখন একই কথা। সে বলছে, গৈলার বাড়িতে মনসা পুজো হতো সাপ আঁকা ঘটে। তাড়াহুড়োয় বাড়ির সবাই পালিয়ে আসার সময় সেই ঘট বাড়ির কোনায় লুকিয়ে রেখে এসেছে। সেটা এনে এ-বাড়ির উঠোনে মন্দির বানাবে। নয়নের মা চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর শ্বাস ছেড়ে বলে, সে-ঘট আনতে পারলে নতুন পল্লীর চেহারাই বদলে যেত গো। এত লোকের এত রকম অসুবিধা আর অসুখবিসুখ থাকত নাকি! খানিকক্ষণ চুপ হয়ে থাকে নয়নের মা। আবারো শ্বাস ছেড়ে বলে, কেরালায় কাজে গিয়ে নয়ন যে টাকা কম পাচ্ছে তারও ব্যবস্থা হয়ে যেত। তবে অতসী যেরকম ভাবছে এখন তো তেমন নেই। এখন মনসা আনতে যাওয়া অসম্ভব। রানাঘাটে ফোন করলে মণিকা দিবাকরকে বলে, শোনো বাবা, তোমার প্রতিদিনের খাটুনির কাজ আর আমার এদিকের সংসার। তোমাদের নাতনির সকালে ইশকুল। আমার উঠতে হয় ভোর পাঁচটায়। মাকে বলো এইসব হাবিজাবি বায়না থামাতে। আর যদি কিছু না শোনে তো একলা পাঠিয়ে দাও ওদেশে। দিবাকর বলে, তা-ই মনে হয় করতে হবে শেষ পর্যন্ত। গত পরশু যখন রাতের দিকে খানিক বৃষ্টি হলো তখন বলছে – এমন বৃষ্টিতেই নাকি শ্রাবণ মাসের দুপুরে তোদের মামাবাড়িতে মনসা পুজো হতো। তারপর সারারাত ধরে রয়ানি গান। সেদিন আবার বলল, পাড়ার বউরা নাকি শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই দল বেঁধে বিকেলে রয়ানি গাইত উঠোনে। মণিকা ফোনে বলে, উঃ বাবা, তুমি আর ওসব কথা শুনো না। এত বয়সে এসে মাকে ভুল জিনিসে পেয়েছে। আর কাছে থেকে থেকে তুমিও কেমন হয়ে যাচ্ছো। রয়ানি গানটানের কথা এখন এদেশে অচল। গান যে অচল তা দিবাকর জানে। অতসীও হয়তো বোঝে খানিক। বছর পঁচিশেক আগে যারা নতুন পল্লীতে আসতে শুরু করেছিল তারা সবাই প্রায় ছিল ওপারের পরিবার। প্রথমে এসেছে আট-দশ ঘর। চাষের মাঠ বিক্রি হয়ে বাস্তুজমি হয়ে যাচ্ছিল। বছর বছর নতুন মানুষ আসছে তখন। যারা পরে আসবে তারা জমি বায়না করে ফাঁকা মাঠে ছোট পিলার পুঁতে রেখে ফিরে গেল। কখনো হাতবদল হলো জমি। এভাবে বিস্তীর্ণ চাষের মাঠ বছর দশেকের মধ্যে তিন ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি আর টিন অ্যাসবেস্টের চালে অন্য রকম পাড়ায় বদলে যায়। এখন গলির ভেতর বিদ্যুতের খুঁটি। বছর তিন-চার বাদে-বাদে ভোট হওয়ায় পাড়ার মোড়ে জলের লাইন, ইটের রাস্তা ঢালাই হয়ে গেছে। সকালে ভ্যানে সাজিয়ে সবজি আনে দুজন, সাইকেলে মাছ। পাড়ারই একজন ঘরের সামনের দিকটা রাস্তার দিকে বাড়িয়ে মুদিদোকান খুলেছে। গলির মুখে ভাড়া ঘরে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আসেন হপ্তায় কদিন সন্ধেয়। মন্দিরও হয়েছে কারো কারো উঠোনে। ছোট জায়গা, ছোট মন্দির। বেশির ভাগ লোকনাথের, একটি কালী, দু-তিন বাড়িতে মনসা। বছরে দিন-তিথি ধরে পুজো হয়। তখন মাইক আনে কেউ কেউ। সারাদিন হিন্দি আর ভোজপুরী ঢঙের বাংলা গান বাজে। ছেলেরা আলোর সামনে নাচে। দলবেঁধে মেয়েদের রয়ানি গানের কথা এদেশে কে আর বলবে! শীতে বা পুজোর পর পাড়ার রাস্তায় কুয়াশা জমলে বাইরেটা খানিক চুপচাপ দেখায়। দিবাকরদের ঘরে নতুন আসা কারেন্টের তারের মাথায় ষাট পাওয়ারের ডুম ফিকে হয়ে জ¦লে। পাশের ঘর থেকে বোবা কথার মতো উঠে আসে ছেলের পড়া মুখস্থের শব্দ। অতসী তখন দিবাকরকে বলে, বিজয়গুপ্তর বাড়ি ছিল গৈলায়। তবে তাকে কেউ দেখেনি। একশ বছর আগে নাকি সেই লোকটা গান গেয়ে সাপকে বশ মানাত। আবার কেউ বলে সে লোকটা মায়া, বাইরের ওই কুয়াশার মতো। তবে তার নামে ছাপা একটা ছেঁড়া পুঁথি দেখেই রয়ানির গান হতো ওদেশে। দিবাকর আরো উদ্বিগ্ন হয়। সকালে কাজে বেরোনোর সময় দেখে সেই নয়নের মা কলতলায়। ট্যাপের জল গলা বাড়িয়ে তার বালতিতে জমছে। নয়নের মা গায়ে কাপড় টেনে নেয়। বলে, তবে কী ঠাকুর পো, অতসী যা বলে তা ভুল কিছু নয়। অনেক আগে ওর বাপের বাড়িতে যেমন যা হতো তা-ই বলছে। রয়ানি গান আর হয়তো শুরু করা যায় না। সেই গান নেই, গাওয়ার লোকও নেই। দিবাকর কাজে বেরোচ্ছে তখন। ট্রেন ধরার তাড়া। তবু এক মিনিট দাঁড়িয়ে যায়। বলে, এসব কথা যদি বরাবর শুনতাম তাহলে এক। এত বছর বিয়ে হলো, ছেলেমেয়ে সব বড় হয়ে গেছে, এখন হঠাৎ করে কি ফিরে যাওয়া মানায়! আর যেখানে ও নিজের দেশ ভাবছে, তা তো এখন বিদেশ। চাইলেই যাওয়া যায় নাকি? দিবাকর এগোয়। নয়নের মা ভরা বালতি সরিয়ে অন্য বালতি বসায়। নিজের মনে বলার মতো বলে, যেজন্য যেতে চাচ্ছে তা এখন অবাস্তব। গৈলার মনসা-বাড়ি এখন খুঁজেও হয়তো পাবে না। শীতকালের কুয়াশা শেষ হলে গরম আসতে থাকে একসময়। পাড়া যখন চাষের মাঠ ছিল তখন মাঠের মাথায়-মাথায় গাছ ছিল কয়েকটা। বেশির ভাগ চলে গিয়ে এখন দু-একটা রয়েছে। তবে নতুন তৈরি হওয়া পাড়ার কোনো বাড়ির উঠোনে এখন লাগানো হয়েছে ছোট আমগাছ, কারো বাড়ির পেছনে জোলো জায়গায় কলার ঝাড়। রাস্তার ধারে আকন্দের ঝোপ রয়ে গেছে এখনো। পাড়া যেখানে শুরু সেই মুখে একটা মাঝারি শিরীষ। দুপুর আর বিকেলের বাতাসে সেসব গাছের পাতা ঝরে যায়। শিরিষের শুকনো লম্বাটে ফল ছড়িয়ে যায় এখানে-ওখানে। অতসীর চোখ-মুখ শান্ত হয়ে যায় আরো। দৃষ্টি ভাবলেশহীন। পাশের ঘর থেকে ছেলের পড়া মুখস্থের গুমোট স্বর ওঠে সন্ধের পর। হলুদ ডুমের আলো ঘিরে কয়েকটা পোকা। লোকাল ট্রেনের শব্দে আর দুলুনিতে দিবাকরের জীবন কেটে যায়।
কিন্তু তার ভেতরেও অতসী রান্না আর ঘরের কাজ সারে। গরম ভাত বেড়ে দেয়। ভাতের ধোঁয়া উঠতে থাকলে বলে, সামনের শ্রাবণ মাসে আমি যেভাবে হোক চলে যাব। আমার জন্যে লোক অপেক্ষায় থাকবে। দিবাকরের হতাশ লাগে কখনো। মণিকা বলে দিয়েছে, মায়ের এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে আর ফোন করো না বাবা। মা যা ভালো বোঝে করতে দাও। মনসা খুঁজতে গিয়ে ও দেশ থেকে যদি আর না ফিরতে পারে তাতেই বা কী করার আছে! দিবাকর গুমরে থাকার ভেতর তেমনই সিদ্ধান্তের দিকে যায়। গৌরনদী, টেকের হাট, বাজিতপুর, এসব জায়গায় অতসীদের এখনো কিছু আত্মীয় রয়ে গেছে। কোনো ভাবে তাদের সঙ্গে যদি যোগাযোগ করা যায়। আজকাল ফোনাফোনির যুগে এদিকের লোকের সঙ্গে ওদিকের লোকের কিছু না কিছু যোগ থাকেই। বর্ডার পার হওয়ার পর তেমন কারো সঙ্গে যদি যোগাযোগ করানো যায় তো ভালো। তার আগে অবশ্য ভিসা-পাসপোর্ট। পরের শ্রাবণ মাসে যাওয়ার কথা শুনে দিবাকর বলে, মছলন্দপুরে একজন আছে পাসপোর্টের দালাল। আঁধার কার্ড, ছবি আর দেড় হাজার টাকা দিলে পাসপোর্ট-ভিসা সব বাড়ি পৌঁছে দেয়। ভোররাতে কলকাতায় গিয়ে লাইন দেওয়ার ঝামেলা নেই। সেই সব শীতের দুপুর পার হলে কলোনির গলিতে পাতা ঝরে যায়। বিকেলের পর পাতা কুড়ানো দক্ষিণের বাতাস আর অনেক দূরে কোনো বাড়িতে পালা-কীর্তনের মাইক বাজে। সেই অস্পষ্ট সন্ধেবেলা অতসী বলে, তুমি পাসপোর্টের দালালের কথা বলছো, আর আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে বর্ডারের লোক। তারা এদিক-ওদিকের মানুষ আনা-নেওয়া করে। তুমি যে টাকার কথা বলছে তার চাইতে কমে তাদের লোক আমারে জায়গায় পৌঁছে দেবে। দিবাকর বলে, তুমি তা হলে যাচ্ছোই? অতসী বলে, যাব, আর ছেড়ে আসা সেই ঘট নিয়ে ফিরব। তারপর আমাদের এই নতুন পাড়া, খোকার লেখাপড়া, তোমরা যাওয়া-আসার কষ্ট, সব কেমন বদলে যায় দেখো। মণিকার বরের সিকিউরিটির চাকরিও পারমেন্ট হবে। দিবাকর বলে, তুমি যখনের কথা বলছো সেসব অনেক আগেকার। সে-সময় অনেক কিছু খাটতো। তখন আর এখনের সময় কি এক? অতসী আবারো তার স্বপ্নের কথা বলে। হোমিওপ্যাথ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আবার তার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেছে। তার স্বপ্নের ভেতর উঠে আসে আগেকার সময়। এক-এক শ্রাবণ মাসে ঝাঁপিয়ে আসা সারাদিনের বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে থাকা দূরের গ্রাম, মাঠের গাছপালা। শ্রাবণেই নাকি বিয়ে হয়েছিল লখিন্দর-বেহুলার। গাঙুর নদী বেয়ে বৃষ্টি মাথায় বেহুলা কলার ভেলায় স্বর্গ খুঁজতে বেরিয়েছিল। বিজয়গুপ্তর পুঁথিতে নাকি লেখা। রানাঘাট থেকে মেয়ে ফোনে জানায়, হোমিওপ্যাথের নিয়মই নাকি এই রকম। প্রথমে অসুখ বাড়িয়ে দেয়, পরে আস্তে আস্তে কমায়। বাবাকে সে বলে, আর কটা দিন ধৈর্য ধরে থাকলে এরপর এমনিই রোগ কমতে শুরু করবে। দিবাকর বলে, ধৈর্য আর রাখা যাবে কী করে! আর দু-এক হপ্তায় বর্ষা এসে যাবে। তখন তোর মাকে আর আটকানো যাবে না। নয়নের মায়ের সঙ্গে দিবাকরের দেখা হয় সকালের কলতলায়। জল নেওয়ার আসরে নয়নের মা-ই বক্তা, অন্যরা শোনে। চিন্তিত মুখের দিবাকরকে ডাক দিয়ে সে বলে, এত করে যখন চাইছে তখন ঘুরে আসুক। স্বপ্ন-আদেশের ব্যাপার। এসব তো উঠেই গেছে আজকাল। তাছাড়া ঘট আনতে পারলে উপকার হবে সবার। কেরালার কাজে ছেলেটার যা খাটুনি শনিবার দিবাকরের ছুটি। দুপুরে খেয়ে ওঠার পর সে ছোট উঠোনটুকুতে হাঁটছিল। তখন বর্ডার পার করার দালাল এসে হাজির। রোগাটে চেহারার একটা লোক। না-কাচা পাজামা-পাঞ্জাবি। উঠোনে দিবাকরের কাছেই সে দিবাকরের নাম করে ঠিকানা খোঁজ করল। দিবাকরের এ লোকটাতে দেখে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। বর্ডার, কাঁটাতার, পাহারা, তার ভেতর দিয়ে এরা পার করে নেয় কী ভাবে? লোকটা উঠোনের মোড়ায় বসে হাঁটুর ওপর হাত রেখে বলল, ওসব ব্যাপারে আমাদের সিন্ডিকেটের তরফে ফুল গ্যারান্টি দাদা। পাসপোর্ট-ভিসা করা লোকও কখনো-সখনো ফেঁসে যায়। আমাদের তেমন না। ওদিকের যেখানে বলবেন সেই পর্যন্ত আমাদের কেউ পৌঁছে দিয়ে আসবে। অতসী চা এনেছিল। এগিয়ে দিয়ে বলল, মুদিদোকানের দাদার কাছে আপনার খোঁজ পাই। গৌরনদী আর গৈলার আপনি নাম শুনেছেন তো! লোকটি প্লেট রেখে চায়ের কাপ আঙুলে তোলে। তালুর ভেতর বিস্কুট টেনে নেয়। বলে, ওইদিকে গত হপ্তায়েও লোক পৌঁছানো হয়েছে। কাঁচরাপাড়ার লোক। শাশুড়ির অসুখ শুনে দেখতে গেল। সাতদিনের ভেতরেই তারে আবার ফিরিয়ে আনা হবে। দিবাকর বলে, আমাদের ইনি গেলে তো দু-চারদিনেই ফিরে আসা। কোনো অসুবিধে নেই তো! লোকটি শব্দ করে চায়ে চুমুক দেয়। হাসিমুখ। মোড়ায় বসে পা সোজা করে। বলে, আমরা দিনে দিনেও ফেরত নিয়ে আসি। তেমন লোকও মাসে দু-চার পিস থাকে। তবে যাওয়ার তারিখ বলবেন, আর মোট রেটের থেকে দুশো কুড়ি টাকা অ্যাডভান্স দেবেন আজ। একটু অবাক হয় দিবাকর। দুশো, আবার কুড়ি টাকা কেন! লোকটি উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমাদের নিয়ম। বায়নার দিন এই টাকা। সিন্ডিকেটের পাকা রসিদ পাবেন। মে মাসের শেষে বেশ গরম। সন্ধের পরে ছাড়া গলির ভেতর এতটুকু বাতাস নেই। সময়ের হিসাবে বর্ষা আসার কয়েকটা দিন বাকি। বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল কখনো। তখন গলির মুখের শিরিষ গাছ থেকে হলদেটে ছোট পাতা ভাসত হাওয়ায়। আর সেসব হতে হতেই বৃষ্টি শুরু হলো কদিনের জন্য। তখন অতসী যেন অন্য কেউ। তার স্বপ্নেরা জেগে উঠল আবার। বাইরের বৃষ্টির ছাঁটের দিকে চেয়ে সে ফিরে যায় বহু কাল আগের মনসা পুজোয়। রয়ানির সুরে বিজয়গুপ্তর পাঁচালি শুনতে পায় সারারাত। ঘুমের ভেতর সে বিড়বিড় করে সুর মেলায়। স্বপ্নের ভেতর দেখে, তাদের গ্রামের পেছনে যে ছোট খালটুকু, সেখানে মান্দাসে ভেসে যায় শায়িত লখিন্দর আর মাথার কাছে বেহুলা। অতসী দিবাকরকে বলে, দেশভাগে তো নদীও ভাগ হয়ে গেছে। এপারের পাহারাদার বেহুলার কলার ভেলা আটকে দিতে পারে। আমি গিয়ে রয়ানি গাইলে যদি তাদের ছাড়ে। তুমি সিন্ডিকেটের লোকটারে মিসড কল দাও। রানাঘাট থেকে মণিকা খবর নেওয়া বন্ধ করেছিল। তবু আগের একদিন সে চলে আসে। বিকেলে তখন গোছগাছ চলছে। মণিকা মাকে বলে, স্বপ্ন দেখে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছো তুমি। সাবধানে থাকার কথা বলার নেই। তবু ভেবো, তোমার জন্য আমরা কয়জনা কিন্তু এদেশে থাকছি।
দিবাকর মেয়েকে বলে, তোর মায়ের সঙ্গে আমি বনগাঁ পর্যন্ত যাব। ফেরার দিন যদি খবর পাই তো চেকপোস্টে গিয়ে দাঁড়াব। দেখা যাক কী আছে সামনে! সেই রোগা চেহারার দালাল লোকটিই নিতে এসেছিল সকালে। তার সেই না-কাচা পাজামা পাঞ্জাবি। পান-খাওয়া দাঁত। দিবাকরের কাছ থেকে বাকি টাকা গুনে নিয়ে অতসীর দুটো ব্যাগ নিজেরই দুই কাঁধে তুলে নেয়। খানিকটা কষ্ট হয় তার। তবু দম সামলে সামান্য হেসে বলে, এদিকের অনেকে এখনো ওদিকের গ্রামের কথা ভুলতে পারেনি। এদিকে বসে মানত করে। ভাবে, উৎসবে কি মেলার সময় যাবে। এইসব লোকই আমাদের কাস্টমার। বাড়ি বসে এরা ঠিক আমাদের খবর পেয়ে যায়। রেলের চাকা গড়ায়। দিবাকর বনগাঁ পর্যন্ত যাবে। প্ল্যাটফর্মে রয়ে যায় রানাঘাট থেকে তুলতে আসা মেয়ে। মুখোমুখি বসা সিটে বর্ডার-পার-করানো লোকটির কাছে দিবাকর হরেক মানুষের গল্প শোনে। কত বিচিত্র টানে যে মানুষ এদিক থেকে এখনো ওদিকে যায়। তাদের যে কত রকম শিকড়! অতসীর কোলের ওপর একটি ব্যাগ। আর একটি পাশে জানালা। বাইরে দূরের আকাশে আবার জমছে বর্ষার মেঘ। আবার বৃষ্টি আসবে। অতসীর দু-চোখ তখন সেদিকেই।