মুরুব্বি ছন্দের একলোক বেতের লাঠিতে ভর করে পাখনা হারানো লোড়া মাছির মতো ভু ভু করতে করতে মুনসেফ বাড়িতে ওঠলো। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই সোজা চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে। বাজুর চাচি চুলায় পানি বসিয়েছে, পানি গরম হলেই তাতে চাল ঢালা হবে। আজ বাড়িতে রান্নার বিশাল আয়োজন। দেখে মনে হতে পারে এ বাড়িতে আজ বিয়ে কিংবা মেজবানি লেগেছে। কিন্তু এ বিশাল আয়োজন এসব কোনো কারণে নয়৷ প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরেই এ বাড়িতে বিশাল ভোজন চলে। মহল্লার আশপাশের ভিক্ষুকরাও এখানে থাকে৷ এখানকার ভিক্ষুকেরা বিশাল পাওয়ারে থাকে৷ তাদেরকে কেউ পাঁচ টাকা ভিক্ষা দিলে তারা সে লোকের মুখে থুতু মারে, অনেকে আছে জাতপাত তুলে গাল মারে। ভিক্ষুকদের মধ্যে একজন থাকে নেতা ভিক্ষুক, আরেকজন থাকে নেতার সহকারী ভিক্ষুক। নেতা ভিক্ষুক আর সহকারী নেতা ভিক্ষুক কে হবে তা ভিক্ষুকরাই নির্বাচন করে। নেতা ভিক্ষুক আর সহকারী নেতা ভিক্ষুককে চেনার উপায় হলো, নেতা ভিক্ষুকের পরনে থাকবে ছিরা প্যান্ট - ছিরা শার্ট, সহকারী নেতা ভিক্ষুকের পরনে থাকবে ছিরা লুঙ্গি- ছিরা গেঞ্জি ; সাধারণ ভিক্ষুকরা থাকবে লুঙ্গি পরে তাদের গা থাকবে খালি। এ লোকের পরনে আছে লুঙ্গি আর ময়লা পাঞ্জাবি। এখানকার ভিক্ষুকরা পাঞ্জাবি পরে না। সে যে ভিক্ষুক না তা সবাই নিশ্চিত কিন্তু এই লোককে কেউ চিনে না। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে মাংস পচা গন্ধ। লোকটার ধারে কাছে কেউ এগুতে পারছে না। লোকটা রান্না ঘরে উঁকি মেরে আবার পেছন ফিরে তাকায় তারপর ময়লা দাঁতে হিহি করে হাসে৷ লোকটার পেটে ক্ষুধা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু এতো সকালে তাকে দেবে কি! ঘরে আছে কিছু শক্ত বিস্কুট, যা এ লোক চিবাতে পারবে না ; তাকে দেওয়ার মতো কিছু নেই৷ আশপাশে কোনো বাজার সাজার ও নেই যে তাকে সেখান থেকে কিছু এনে দেবে। বাজার প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। বাড়ির পাশে একটা মাত্র দোকান, তাতে কেবল আছে কম দামি সিগারেট আর রঙ চা। লোকটা সাদেক আলির ঘরের দরজায় যেয়ে পা ছড়িয়ে বসে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। লোকটা তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে৷ তারপর কাগজটাকে তিন খণ্ড করে তার সামনে ত্রিভুজাকৃতিতে সাজায়। পুনঃপুন করে কিছু পড়তে থাকে। এর মাঝে অনেক লোক তাকে ঘেরাও করে ফেলেছে। সবাই নাকে-মুখে হাত চেপে ধরে আছে কিন্তু কেউ একচুল নড়ছে না। সবাই লোকটার কর্মকাণ্ড দেখছে৷
মুনসেফ বাড়ি এ মহল্লার সব থেকে নাম করা বাড়ি। আগ থেকেই এ বাড়িতে সব খানদানি লোকেদের বসবাস। এখন তেমন খানদানি লোক না থাকলেও এ বাড়ির লোকেদের খানদানি চলা আর বাড়ির খানদানি নামটা আছে। বর্তমানে এ বাড়ির হর্তাকর্তা হলো খালিদ সাহেব। লোকটার কথা খালিদ সাহেবের কানে গেলে তিনি জল টং থেকে জলদি গায়ে গামছা প্যাঁচিয়ে সাদেক আলির ঘরের সামনে চলে আসেন। এসে দেখলেন অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। তিনি সবাইকে যার যার মতো পাঠিয়ে দিলেন। লোকটা কোন কথা বলছে না, এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে কাগজখণ্ড গুলোর দিকে। খালিদ সাহেব লোকটার কাছে এগিয়ে গেলেন, লোকটা মাথা উঁচু করে তার দিকে নিরুপায়ের মতো তাকিয়ে রইলো৷ খালিদ সাহেব বললেন-
' এই বাড়ি কই?'
' কবরে।'
' কবরে মানে! তুই কি লাশ নাকি আত্মা!'
লোকটা মাথা নাচিয়ে পাঞ্জাবি ওপরে ওঠিয়ে বলল, আমি নাশ ; এই যে দেখেন মাংস পচা ধরছে।'
বিয়ের আলাপ অনেক দিন ধরেই চলছিলো, অবশেষে দিন-তারিখ ঠিক হলো। আগামী মঙ্গলবার বাজুর বিয়ে। এক দিকে বাড়িতে বিয়ের আয়োজন, অন্যদিকে সাপ্তাহিক ভোজন, তার মাঝে কোথা থেকে এসে জুটলো এক অদ্ভুত লোক! বাড়ির লোকেদের লেজেগোবরে অবস্থা। খালিদ সাহেব সাকিবকে বলল এ লোককে খুব শিগ্গির-ই বাড়ির বাহিরে রেখে আসতে। সাকিব লোকটার ধারে কাছে যেতে রাজি হয় না৷ সে খালিদ সাহেবকে মুখের ওপর বলে দেয়, পারবে না। লোকটা এবারে ওঠে দাঁড়ায়। সবাই হা করে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা খালিদ সাহেবের দিকে দু'পা এগিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, ' মানুষের মাংস পচা গন্ধ খুব ভয়ংকর হয় ; এর থেকেও ভয়ংকর হয় কলিজা পুড়া গন্ধ। তবে মাংস পচা গন্ধ দূর থেইকা ও পাওয়া যায়, কলিজা পুড়া গন্ধ পাশ দিয়া পইরা থাকলেও পাওয়া যায় না।' লোকটা এ কথা বলে তার পেট থেকে পচা মাংস মুষ্টি ধরে ছিঁড়ে ফেলে তারপর নিজেই সে মাংস রাক্ষসের মতো চিবিয়ে খেতে থাকে। এ লোকের কাণ্ড দেখে সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায়। যার যার ঘরে গিয়ে সবাই দরজা আটকে ভয়ে কাপতে থাকে। তারপর লোকটা পিলপিলিয়ে হেঁটে এক দিকে চলে যায়।
বাজুর প্রাক্তন প্রেমিক বাজুকে বলেছে সে যদি তার সাথে পালিয়ে না যায় তাহলে সে ছাদ থেকে ঝাপ দেবে। বাজুও মুখের ওপর বলেছে, ' পালামু ক্যান! বিয়া আমি করুমই ; গোলাম পারলে ঝাপ দিছ।' বাজু বিয়ের আনন্দে আছে। তার প্রাক্তন বাড়ির কোনা-কাঞ্চি দিয়ে ঘুরঘুর করছে। তার হাতে বিষের বোতল। সে বিষের বোতল আগেই কিনে রেখেছে। সে ভেবেছে এ বিষ বাজুর বিয়ের দিন খাবে৷ বিয়েতে কবুল বলার সামান্য আগ মুহূর্তে সে বাজুর সামনে দাঁড়িয়ে এ বিষ পান করবে, তখন বাজু বিয়ের আসর ছেড়ে তার কাছে ছুটে আসবে তারপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তারপর সেই বিয়ে ভেঙে গেলে তার সাথে বাজুর বিয়ে হবে। এ রকম দৃশ্য বাংলা সিনেমার পর্দায় অহরহ দেখা যায়। সেখান থেকেই বোধহয় খোদারকাটা এই বুদ্ধি বের করেছে। বিষের তেমন তেজ নেই, তার হাতে একটা কম তেজি বিষের বোতল ; এটা পান করার মানে হচ্ছে একটা আতঙ্ক তৈয়ার করা।
' হুমুন্দির পুত তুই বিষ যখন খাবি ভালা কইরা খা! প্রয়োজনে ইন্দুরের ওষুধ খা ।'
প্রতি বৃহস্পতিবার মুনসেফ বাড়িতে যে ভোজন চলে আজ তা বন্ধ। সকালে ঐলোকের কাণ্ড দেখে রান্না তো দূরের কথা কেউ ঘর থেকেই বেরোয়নি। ভিক্ষুকরা এসে বাড়ির লোকেদের আল্লাহ-খোদার নাম নিয়ে ডাকে। কেউ দরজা খুলে না, তারপর তারা চলে যায়।
বাজুর প্রাক্তনের নাম বিশাল। তাকে বাড়ির আশপাশে ঘুরতে দেখে পেছন থেকে একজন হুজুর টাইপের লোক এসে জিজ্ঞেস করলো :
- এই মিয়া! এনে ঘুরাঘুরি করেন ক্যান?
- মরার জন্য৷
- ছেদ ফাইট্টা পরে৷ দেখি, হাতে কি?
- এই যে দেখেন বিষের বোতল, এইবার বিশ্বাস হইছে? এখন যান।
- এ বিষে মরতে পারবেন না৷ হুদাই কতক্ষণ ব্যাঙের মতো ফালাইবেন৷ আমার কাছে হেমলক বিষ আছে। এই বিষ খাইয়া বিজ্ঞানী সক্রেটিস মারা গেছে। এই বিষ খাইলে আপনের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে আপনে মারা যাবেন৷ আপনেরে এইসব কইয়া লাভ নাই৷ আপনে তো ইনশাআল্লাহ মারা যাবেন। মারা যাবেন এটাই এক মাত্র লক্ষ উদ্দেশ্য।
- এই মিয়া এতো কথা কন ক্যান! যান নিজের কামে যান৷
- আমার কামের সময় হয় নাই। আরো দেড় ঘন্টা বাকি৷ তারপরে আসরের আজান৷ এখন এদিকেই থাকি৷ যখন তখন আপনের জানাজা পরানো লাগতে পারে৷
বিশাল বিরক্ত হয়ে এবার হুজুরকে জোর করে ধরে মুখে বিষের বোতল ঢোকিয়ে দেয়। তারপর সে দৌড়ে চলে যায়৷ হুজুর তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ' আরে ভাই এটা তো বিষ না, ভেতরে নাপা শিরাপ। দাড়ান বিষ নিয়ে যান৷ হেমলক বিষ আমার পকেটে আছে৷ যখন ইচ্ছা খাইবেন, সাথে সাথেই ফুটুস।'
মঙ্গলবার দুপুরে মুনসেফ বাড়িতে বরযাত্রী এসে হাজির হন। বাজু বিয়ের সাজে বসে আছে৷ তখন সেই বৃদ্ধ লোকটি আবার আসে৷ আজ তার গায়ে পাঞ্জাবি নেই। গায়ের পচা মাংস গুলোতে মাছি ভু ভু করছে, আজ দুর্গন্ধ আরো বেড়ে গেছে। লোকটি হাতের লাঠির ওপর ভর করে পিলপিলিয়ে বাজুর সামনে এসে দাঁড়ায়। বাজু ভয়ে কাপতে থাকে, নাক-মুখ দু'হাতে চেপে ধরে। তখন লোকটা তার হাতের উপর ভাজ করা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা মরা ইঁদুর বের করে তা কামড়ে খেতে থাকে। তখন সবাই পালাতে শুরু করে। বাজুর প্রাক্তন বাজুর সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন সেই লোকটি মাটিত লুটে পরে।
সেদিন আর বিয়ে-সাদি হলো না। পরের সপ্তাহে আবার বিয়ের তারিখ দেওয়া হলো৷ এবার আর বিয়ে ভাঙার কোনো রকম আশঙ্কা নেই। লোকটিকে একটা বদ্ধ করে বন্দি করে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে চাইলেই সে বেরোতে পারবেনা। খবর পাওয়া গেছে, বরযাত্রী কাছাকাছি চলে এসেছে। সাকুল্যে সময় লাগতে পারে আর আধ ঘণ্টা। বাজু বধূ ভেসে বসে আছে বিয়ের আসরে। তার গা ঝকঝক করছে সোনার গহনায়৷ বিশাল বিষের বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পাশের মোহনায়। যখন তখন গরগর করে মুখের ভেতর বিষ ঢেলে দেবে। আজ তার হাতে এক মারাত্মক বিষ। সাপের বিষ, ইঁদুরের ওষুধ, হেমলক এই তিনের মিশ্রণে গঠিত আজকের বিষ ; এটি তার নিজস্ব রেসিপি।
কিছুক্ষণ পর বরযাত্রী'র গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেলো। সাথে পাওয়া গেলো ঢাকঢোলের আওয়াজ ও। তখন বাজুর প্রাক্তন আর সেই মুরুব্বি ছন্দের লোকটি এক সাথে এসে বাজুর সামনে হাজির হয়। বিশাল তার মুখে গরগর করে বিষ ঢেলে দেয় আর লোকটির সারা গা থেকে পুঁজ পরতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে লোকটা বাতাসের সাথে মিশে যায়, আর বাজুর প্রাক্তনের দেহ পরে রয় বাজুর সামনে।
বাজুর বিয়ের পর মুরুব্বি ছন্দের লোকটাকে আবার দেখা যায়, সে একটা কাগজখণ্ড এনে বাজুর কাপড়ের ভাজে রেখে দেয়। তারপর বাতাসের সাথে মিশে যায়। বাজু তার কাপড়ের ভাজে কাগজখণ্ড পেয়ে বুঝতে পারলো এটা কার কাজ। কাগজ খণ্ড লেখা হয়েছিলো মানুষের পুঁজ দিয়ে। বাজু সে কাগজখণ্ড পড়ে দেখলো না, কাপড় সহ সে কাগজের খণ্ড সে পুড়িয়ে দেয়। তখন বাজুর প্রাক্তন অদৃশ্য হয়ে বলতে থাকে :
ভূমিকম্পে ধসে পরে বিশাল বিশাল সৃষ্টি,
কোনো কম্পন ছাড়াই ভেঙে গেলো
আমার হৃদয় ;
দেখো একবার দিয়ে দৃষ্টি।