প্রকৃতি কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় না।
মানুষ যেমন হয়।
প্রকৃতি কখনো অভিসম্পাত করে না।
মানুষ যেমন করে।
প্রকৃতি কখনো লোভী হয় না।
মানুষ যেমন হয়।
প্রকৃতি হয় শান্ত-স্নিগ্ধ-অপ্রতীম।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, প্রকৃতি কখনো হৃদয় আর ভালোবাসার সঙ্গে ধোঁকা দিতে পারে না।
কিন্তু আমরা যারা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করি, সেই আমরা হৃদয় ভাঙি, ভালোবাসার সঙ্গে করি মিথ্যাচার। ভাঙাগড়ার খেলায় জলকাদা মিশিয়ে একাকার করে দিই। প্রকৃতিও তখন বিস্মিত হয়।
‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ – বলেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবিতার এই পংক্তিটি যেন মনে বসন্তের সূচনা এনে দেয়৷ তবে ফুল না ফুটলে কী চলে!
ফুল ফুটবে, বন বনান্তে কাননে কাননে রঙিন কোলাহলে ভরে উঠবে চারদিক। শীতের জীর্ণতা দূর হয়ে নতুন সাজে সেজে উঠবে প্রকৃতি। কারণ, বসন্ত যে ঋতুরাজ।
প্রকৃতি আর ভালোবাসা একে অপরের সাথে গভীর সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা। ভালবাসা ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের ভিতর।
মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পরের পরিপূরক, প্রকৃতি ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না; তেমনি মানুষ ছাড়াও প্রকৃতিরও মূল্য নেই। প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানে নিজেকেই ভালোবাসা। এই যে পাহাড়, বন, শস্যখেত, নদী ও সমুদ্র নিয়ত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। আমরা যখন সমুদ্রে যাই প্রকৃতিকে পাই, আমরা যখন পাহাড়ে যাই প্রকৃতিকে পাই। এই যে পাহাড়ের অবিরাম ঝরনা ধারা, এই যে সমুদ্রের অশান্ত তরঙ্গমালা মানব মনে অনির্বচনীয় অনুভূতি এনে দেয়, এই যে বনের সবুজ বৃক্ষরাজি, পাখপাখালি কী অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।
মানুষ ও প্রকৃতির নৈকট্যই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। মানুষ যখনই প্রকৃতিকে আপন করে নেয়, তখনই সে হয়ে ওঠে প্রকৃতির মানুষ, ভূমি ও বৃক্ষের অত্যন্ত কাছের মানুষ। আর মানুষ যখনই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যায়, সে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, সেই সঙ্গে পৃথিবীরও।
বাংলাদেশকে বলা হয় ১৩ শত নদীর দেশ। আসলে কত নদী আছে তার ঠিক হিসেব নেই। অনেক নদী মরে গেছে, অনেক নদী মাঝপথে গতি হারিয়েছে। অনেক নদী আমরা হত্যা করেছি। তাই বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে আমাদের নদী ও বন হত্যা বন্ধ করতে হবে।
উত্তর ও পূর্বদিকে বাংলাদেশের সীমান্তটির দিকে তাকিয়ে দেখুন, যেখানে পাহাড় শেষ, সেখানেই বাংলাদেশের শুরু। আমরা সমতল ভূমি পেয়েছি, নদী পেয়েছি, সুন্দরবন পেয়েছি। এটিই বা কম কীসে? প্রকৃতি তো কেবল পাহাড়ে বা সমুদ্রে থাকে না। সমভূমিতেও থাকে; থাকে মানুষের ভালোবাসায়। সেই ভালোবাসা নেই বলেই আজ প্রকৃতি মানুষের প্রতি বিরূপ আচরণ করছে।
রবীন্দ্রনাথ ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য বলে আক্ষেপ করেছিলেন। শহরে প্রকৃতি নেই বলে ভালোবাসা নেই, স্নেহ মমতা নেই। এই ভালোবাসার টানেই জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ পদ্মার পাড়ে ছুটে গিয়েছিলেন। তার কাব্য, তার গান, তার ছোট গল্পের বিরাট অংশজুড়ে আছে প্রকৃতি, আছে পদ্মা ও তার দুই পাড়ের শ্যামল প্রান্তরের জীবনধারা। এই পদ্মার বোটে বসেই তিনি লিখেছিলেন সোনারতরী। নদী মানে কেবল পারাপার নয়, নদী মানে কেবল চলাচল নয়, নদী মানে জীবন, নদী মানে স্বপ্ন, নদী মানে ভালোবাসা।
সুন্দরবনকে আমরা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার মনে করি, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বলে দাবি করি। অথচ সেই সুন্দরবনকে রক্ষায় আমরা কিছুই করছি না; পৃথিবী বিখ্যাত যে বেঙ্গল টাইগার, তাদেরও আমরা মেরে ফেলছি। মেরে ফেলেছি এখানে উদ্ভাবিত নানা বৃক্ষ ও উদ্ভিদ। সুন্দরবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বনবিদ খসরু চৌধুরী লিখেছেন : ‘আদিডাঙ্গার মোহনা থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত এলাকায় গঙ্গা, পদ্মা-মেঘনার অনেক দক্ষিণ শাখা নদী ও সাগরে বিলীন হয়। ফলে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকা পর্যন্ত গড়ে ওঠে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মোহনা অঞ্চল।…’ সুন্দরবন গড়ে উঠেছে গাঙ্গেয় মোহনার কয়েকশ’ দীপাঞ্চলের বনভূমি নিয়ে। বসতির বিস্তৃতি এবং গড়ে ওঠা খেতখামারের কারণে সুন্দরবনের আয়তন এখন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার হবে। এর মধ্যে নদীনালা ও খালবিল ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বাংলাদেশের ভাগে পড়েছে সুন্দরবনের ৬ হাজার ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এর মধ্যে জলের ভাগ ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। স্বাভাবিক নদী কালিহাতী ও বিভাজন করে আছে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন। সুন্দরবনের গাছপালার মধ্যে রয়েছে গর্জন, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুর গোলপাতা আর পশুপাখির মধ্যে রয়েছে: বাঘ, হরিণ, বনমোরগ, শিয়াল ইত্যাদি। সুন্দরবন না থাকলে যে এসব কিছুই থাকবে না, প্রকৃতি-বিধ্বংসী মানুষ তা বোঝে না।
প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশ মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের পক্ষে সহায়ক। নির্মল বাতাস, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত খাদ্য সুস্থ ও সুন্দরভাবে মানুষকে বাঁচাতে সহায়তা করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ও মানুষের লাগামহীন দূষণমূলক কর্মের ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীতে সুস্থভাবে টিকে থাকতে পরিবেশ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বব্যাপী সামাজিক উন্নয়নেও যুবদের নেতৃত্ব পরিলক্ষিত হয়। সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি, সম-অধিকার, ন্যায়নিষ্ঠতা এবং সুপরামর্শেও যুবদের নেতৃত্ব রয়েছে। সমাজের দুস্থদের পাশে দাঁড়াতে যুবরা দারুণ কর্মচঞ্চল। তাদের অসময়ে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছে যুবরাই। সৎ ও যৌক্তিক পরামর্শের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলছে আদর্শ সমাজকাঠামো। সুশৃঙ্খলবদ্ধ সামজ তৈরিতে যুবদের যে প্রচেষ্টা, তা সামজকে পরিবর্তন করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও অনুপ্রাণিত করছে।
প্রকৃতি শুধু আমার নয়। আমরা প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি আমাদের সবার। আসুন আমরা আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করি, আমরা নিজেদের রক্ষা করি। কেননা, প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানেই নিজেকে রক্ষা করা। প্রকৃতি পৃথিবীর আর্শীবাদ। এ গ্রহে জীব বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন প্রকৃতি।
প্রকৃতি লোভ বা ধ্বংস নয়; সৃষ্টি, সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্যের সঙ্গে সহাবস্থান শেখায়। প্রকৃতি, প্রাণী ও পাখিদের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে উদার ও মননশীল করে। তাদের সঙ্গ মনে-প্রাণে ভিন্ন মাত্রার প্রশান্তি ও স্বস্তি এনে দেয়। তাই আমরা যেন প্রকৃতিকে ভালোবাসি, প্রকৃতিতেই বেঁচে থাকি ও প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেই।
বাংলাদেশের ঋতুচক্রে ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। এটি বছরের শেষ ঋতু। দখিনা ঝির ঝিরে বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে আসে বসন্ত। শীতের নির্জীব প্রকৃতি যেন সহসা জেগে ওঠে। শীতের পরে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ আর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। দখিনা মলয়ে বসন্ত ঋতুর আগমনী বার্তা শোনা যায়। কবির কাছে বসন্ত ঋতুরাজ, ভাবুকের কাছে এ ঋতু যৌবনের ঋতু বলে আখ্যায়িত।
বসন্তের আগমনে প্রকৃতি তার জীর্ণতা মুছতে শুরু করে। শীতের পাতাঝরা বৃক্ষগুলো এত দিন যেন বিগত যৌবনা বৃদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে ছিল রিক্ত বেশে। বসন্ত এসে তাকে দান করে যৌবনের উন্মাদনা।
একদিকে বসন্ত যেমন প্রকৃতিকে নতুনরূপে সাজায় তেমনি মনের বসন্তকে নতুন রূপ দেয় ভালোবাসা। তারুণ্য মনে জোয়ার আনুক বসন্তের অগ্রযাত্রা। ভালোবাসা বিস্তার করুক প্রতিটি মানুষের মনে। ভালোবাসার পবিত্রতা রক্ষিত থেকে পূর্ণতা পাক মানুষের মনবাসনা। প্রকৃত ভালোবাসা আর প্রকৃতির ভালোবাসায় তরুণরা উজ্জীবিত হোক। দিকে দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক। বসন্তের রঙে জীবন হয়ে উঠুক ভালোবাসাময়।