• আজ- শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২৫ অপরাহ্ন

পল্লী কবির কর্মজীবন ও সাহিত্য চর্চা

বিধান চন্দ্র দাশ / ২১২ বার দেখা হয়েছে
আপডেট : শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪

add 1

ঠাকুর বাড়ির সবার সাথে কবির সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বেশি হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। কবির জসীম উদ্দীন ছাত্র থাকাকালে ‘কবর’ কবিতাটি লিখেছিলেন। ১৯২৫ সালে কবর কবিতাটি কল্লোল পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পত্রিকায় ছাপা হলে ভূমিকম্পের পূর্বে ভূগর্ভে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তেমনি জনগণের ভিতর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। জসীমউদ্দীনকে দেখতে প্রতিদিন মানুষ ভিড় জমাতো কলেজে। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেনের সহযোগিতায় উক্ত কবিতাটি সে সময় কলেজ পাঠ্যবইতে স্থান পেয়েছিল। কবির বিয়ের কথা না লিখলে হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মমতাজ যখন ১০ম শ্রেণির ছাত্রী, কোন ক্রমে জসীমের সাথে মমতাজের দেখা হয়ে যায়। কবির এক দেখাতে মমতাজকে পছন্দ হয়েছিল। তারপর পারিবারিক ভাবে উভয় উভয়ের সম্মতিতে ১৯৪৩ সালে বিয়ের কার্য সম্পাদন হয়। সেই থেকে মমতাজের নাম হয় মমতাজ জসীম উদ্দীন। কবি মমতাজকে ডাকতেন মনিমালা বলে। ১৯৩৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর জসীম উদ্দীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে তৎকালীন সরকারের অধীনে তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার ভালো ভালো রচনা গুলো ছাত্র অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে দুমুখো চাঁদ, রাখালী, নকশি কাঁথার মাঠ, বালুচর, ধানক্ষেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রঙিলা নায়ের মাঝি প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। এসব কাব্যগ্রন্থের জন্য জসীম উদ্দীন বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। চাকুরী জীবনে তার কাব্য ও লোকনাট্যগুলি রূপবতী, এক পয়সার বাঁশি, পদ্মাপার, মাটির কান্না, গাঙের পার ও সখিনা। গদ্য রচনা গুলির মধ্যে ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়, চলে মুসাফির, বাঙালির হাসির গল্প ইত্যাদি। অবসর গ্রহণের পর তার আরও উল্লেখযোগ্য বই গুলো ভয়াবহ সেই দিন গুলিতে, জলের লেখন, হলুদ বরণী, মা যে জননী কাঁদে, মাগো জ্বালিয়ে রাখিস না আলো। তার উপন্যাস ধর্মী বইগুলির মধ্যে বোবা কাহিনী ও গল্পগ্রন্থ রাঙ্গাবতীর হাসির গল্প (২য় খন্ড)। ভ্রমন কাহিনী মূলক বই গুলির মধ্যে যে দেশে মানুষ বড়, জার্মানীর শহরে বন্দরে, হলুদ পরীর দেশে, কবির কাব্যগ্রন্থের রচনা সাল- ১৯২৭ সালে রাখালী, ১৯৩১ সালে বালুচর, ১৯৩৩ সালে ধানক্ষেত, ১৯৩৪ সালে সোজন বাদিয়ার ঘাট, ১৯৩৮ সালে হাসু, ১৯৪৬ সালে রূপবতী, ১৯৫০ সালে পদ্মাপার (নাটক), ১৯৫১ সালে মধুমালা (গীতিনাট্য), ১৯৫১ সালে বেদের মেয়ে (গীতিনাট্য), ১৯৫১ সালে মাটির কান্না, ১৯৫৬ সালে এক পয়সার বাঁশি, ১৯৫৯ সালে সখিনা, ১৯৬১ সালে সুচয়নী, ১৯৬২ সালে ভয়াবহ দিনগুলিতে, ১৯৬৩ সালে মা যে জননী কাঁদে, ১৯৬৬ সালে হলুদ বরণী, ১৯৬৯ সালে পদ্মা নদীর দেশে, ১৯৭৮ সালে কাফনের মিছিল (মরোণোত্তর), এছাড়াও আছে ডালিম কুমার, রূপবান, ১৯২৯ সালে নকশি কাঁথার মাঠ বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হয়। এভাবে বাংলা সাহিত্যকে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কবি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মাসিক ৭০ টাকার বিনিময়ে প্রায় ১০ হাজার লোকগান সংগ্রহ করেছিলেন। এগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহ শালায় আছে। এছাড়া কবি বহু গান রচনা করেছেন। তিনি একজন স্বনামধন্য গীতিকার। তার বেশিরভাগ গানের সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন আব্বাস উদ্দীন আহমেদ। তার গানগুলির মধ্যে-

আমার সোনার ময়না পাখি…।
নিশিতে যাইও ভ্রমর…।
আমায় ভাসাইলি রে…।
রঙিলা নায়ের মাঝি …।
রঙ্গিলা রঙ্গিলা কই গেলা রে…।
তুমি দেখা দাও হে দরদী …।
ও মোর কালা রে…।
আমার হাড় কালা করলি রে…।
বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে …।
প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কে…

এছাড়া কবি গোলাম মোস্তফার সংস্পর্শে এসে বহু ইসলামী গান রচনা করেন। তার শ্রেষ্ঠ গান গুলি এইচ এম ভি রেকর্ড কোম্পানীতে রেকর্ড করা হয়। সেই থেকে গান গুলি আজও গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছে। এ গানের মধ্যে মা, মাটি, মানুষের তথা পল্লীর রূপ ও বৈচিত্র কবি অত্যান্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। পল্লীর অবহেলিত মানুষের সুখ, দুঃখ, প্রেম-প্রীতি ভালবাসার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এ গান গুলি। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের যে গীতি নাট্যগুলি নিয়ে চলচিত্র নির্মান হয়েছে তার মধ্যে রূপবান, ১২ দিনের রাজার ছেলে রহিম, ১২ বছরের মন্ত্রীর মেয়ে রূপবানকে নিয়ে গীতিনাট্যের মাধ্যমে তাদের অপূর্ব প্রেম কাহিনী যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় বিমুগ্ধ করে। তেমনি মধুমালা, সোজন বাদিয়ার ঘাট ইত্যাদি চলচিত্র গুলো দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। পল্লী কবির গান হিন্দী চলচিত্রেও স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে ১৯৫৭ সালে যে ছবিটি নির্মান হয় সেই ছবিটিতে রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে, আমারে ছাড়িয়া তুই কই গেলা রে। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শচীন দেব বর্মণ। ১৯৫৫ সালে কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দি সিনেমা দেবদাস উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত দেবদাস ছবিতে নিশিতে যাইও ভ্রমর…, এ গানটি স্থান পায়। এ গানটিরও সংঙ্গীত পরিচালনা করেন শচীন দেব বর্মন। কণ্ঠ দিয়েছেন মান্না দে ও গীতা দত্ত। জসীম উদ্দীন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তার প্রতিটি কবিতায় পল্লীর অপরূপ দৃশ্য, খেটে খাওয়া মানুষের দুঃখ দূর্দশার কথা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। যেমন আসমানী কবিতা।

আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও
রহিম উদ্দীন ছোট্ট বাড়ি রসূলপুরে যাও।

এ কবিতায় গ্রামের মানুষ গুলি যে কত অসহায়, হতদরিদ্র, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ তাদের করুণ কাহিনী স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। মামার বাড়ী কবিতায় কবি ছোটদের জন্য লিখেছেন-

আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।

এ কবিতায়ও কবি পল্লীর রূপ ও বৈচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

আমার বাড়ি যাই-ও ভ্রমর, বসতে দিব পিড়ে
জল পান যে করতে দিব শালি ধানের চিঁড়ে।

কবি এ কবিতায়ও পল্লীর একই রূপ বর্ণনা করেছেন।

রাখাল ছেলে কবিতায়-
রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গায়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও।

পালের নাও কবিতায়-
পালের নাও পালের নাও পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও।

সবার সুখে কবিতায়-
সবার সুখে হাসব আমি কাঁদবো সবার দুঃখে,
নিজের খাবার বিলিয়ে দেব অনাহারীর মুখে।

এ কবিতায় কবি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ কবি সাম্যবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। সমাজের বুভুক্ষ আত্মনিপীড়িত, আশ্রয়হীনদের কথা ভেবে কবিতাটি রচনা করেছেন। তার কবিতার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
নিমন্ত্রন কবিতায় কবি লিখেছেন-
তুমি যাবে ভাই যামে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়

কবি এখানেও গ্রামের দৃশ্য তার শহরের বন্ধুর কাছে বর্ণনা দিয়ে শহরের বন্ধুকে গ্রামে আসার জন্য নিমন্ত্রন দিচ্ছেন।

কবর কবিতার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কবর কবিতাটি পড়লেই যে চোখ দিয়ে পানি নেমে আসে। এখানে প্রেম প্রীতি, ভালোবাসা এবং সুখ-দুঃখের কথা গভীর ভাবে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন।

কবি লোকসাহিত্যের গবেষক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, ইতালি, যুগোশ্লোভিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক লোক সাহিত্য সম্মেলণে নিজ দেশের নের্তৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু দেশাত্ববোধক গান রচনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তির প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি লিট উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালে রক্তঝরা দিনগুলি প্রত্যক্ষ লক্ষ্য করেছেন। পাকিস্তানি শাকদের স্বৈরাচার ও বর্বরতা দেখে কবি গভীরভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন। ঢাকা শহরে জীবনের শেষের দিকে এসে কবি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য তিনি জার্মানীতে যান। কবি সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৭৬ আবার অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা পি.জি হাসপাতালে ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৪ই মার্চ তিনি দারুণভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তার অল্প কিছুক্ষণ পর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কবি তার স্মৃতি পট বইয়ের ২য় সংস্করণের মুখবন্ধে লিখে গেছেন, এখন হইতে আমার নামের আগে পল্লী কবি একথাটি যুক্ত থাকবে। ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর আগে ২১শে পদকে তাকে ভূষিত করা হয়। সারা জীবন তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন আপন প্রতিভার গুণে বিশ্ব কবি। বিদ্রোহী কবিতার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বিদ্রোহী কবি। জসীম উদ্দীনের প্রতিটি কবিতার মধ্যেই পল্লীর ভাব বৈচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই তো তিনি পল্লী কবি নামে পরিচিত। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে জসীম উদ্দীন হল। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়। সেখানেই তিনি চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। কমলাপুর রেলষ্টেশনের কাছে কবি যে রাস্তার পাশে থাকতেন পরে তার নামকরণ করা হয়েছে জসীম উদ্দীন রোড। বাংলা সাহিত্য জগতে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের নাম বাঙালির হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

add 1


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য লেখা সমূহ

আজকের দিন-তারিখ

  • শনিবার (রাত ১০:২৫)
  • ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ১৮ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬
  • ৬ পৌষ, ১৪৩১ (শীতকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Sundarban IT