তোপধ্বনি শুনে নড়ে চড়ে ওঠে বৃদ্ধ শের আলী, স্থবির শের আলী মনে বল পায় যেন ঐ শব্দে রক্তে নাচন লাগে, যুদ্ধের কথামনে পড়ে যায়- তার, মুক্তিযোদ্ধা শের আলী এখন পঙ্গুত্ব জীবন-যাপন করছে, মনের জোর নেই আগের মত, তার উপর স্ট্রোক হানাদিয়েছে বলে শের আলীর শরীরে কোন রকম ক্রাচে ভর করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে সে মনে হয় জীবন যুদ্ধে এক পরাজিত সৈনিক শের আলী। ২১ বার তোপধ্বনির শব্দে ঘুম ভাঙে শের আলীর ক্রাচে হাত রেখে পাগলের মত ডাকতে থাকে মেহের আলীকে। মেহের আলী তার পোতা ছেলে, মেহের আলীর বাবা জোহর আলী লিভার সিরোসিসে মারা গেছে। ভালো চিকিৎসা হয়নি তার। শের আলী মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সেই সার্টিফিকেটে আর পেট ভরে না। তখন ছেলের চিকিৎসা করার মত সামর্থ ছিলনা তার। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছিল আর গ্রামের লোকজনের চেষ্টার ত্র“টি ছিল না। কিন্তু রাজধানীতে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি কেউ অবমেষে জোহর আলী মারা গেল। বৃদ্ধ শের আলী আবার চিৎকার দেয় কিরে মেহের আলী এখনো উঠলিনে? মেহের আলী চোখ মুছতে মুছতে দাদুর কাছে আসে। ঘুম ঘুম চোখে সে বলে দাদু আবার ডাকা ডাকি, করতে ছাও ক্যান’ শের আলী সস্নেহে বলে, দাদুভাই, আজ সেই বিজয় দিবস, আমার একটু মরিচ্চাপ নদীল কাছে নিয়ে যাবি। মেহের আলী একথার অর্থ বোঝেনা, কৌতুহল ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহের বলে কেন হনে কি করতি যাবা, হনে তোমার কি? ও তুই বুঝবি না দাদু ভাই আমার একটু নিয়ে চলনা দেখবি অনেক গল্প করবো। গল্প করবা তা হনে কেন? বাড়ী বসে করো শের আলী রেগে যায়, বাঘের মর্ত গর্জন দিয়ে বলে, মেহের আলী বেশি বুঝতে চাসনে, আমারে মরিচ্চাপ নদীর কাছে নিয়ে চল। হাফায় শের আলী চোখ দুটো লাল রেগে গেলে এমন হয়। অবশেষে মেহের এর ঘাড়ে ভর দিয়ে নদীল কাছে যায় শের আলী নদীর দিকে উদাস চোখে চেয়ে থাকে সে, মেহের বলে, কি দেখো দাদু? নদী মরিচ্চাপ নদী এক সময় এই নদীতে লঞ্চ চলতো, স্টীমার চলতো আর কত কিছু। দাদু এখন চলেনা কেন? এখন তো নদী বুজে গেছে। জানিস মেহের একাত্তরে এই মরিচ্চাপ নদীতে ভয়ঙ্কর স্রোত ছিল এই নদীর ধার বেয়ে আমরা সেদিন যুদ্ধ করেছিলাম বডারে যুদ্ধ করতে যেয়ে একটা গুলী এসে লাগলো পায়ে সেই গুলী বের করতে যেয়ে পায়ে হলো সেপটিক তার থেকে গ্যাংগ্রীন অবশেষে পা কেটে বাদ দিতে হলো। এখন তোমার কেউ দেখেনা দাদু ভাই? কে দেখবে আবার মাঝে মধ্যে পাড়ার ছেলেরা অনুষ্ঠান করে ২/১ বার লুঙি পাঞ্জাবী আর কখনো সার্টিফিকেট মত কি দিয়েছিল এখন আর কেউ কিছু দেয় না, কেউ ডাকেও না। শের আলীর অতীতের কথা মনে পড়ে যায়, হাউ মাউ করে মেহের কে জড়িয়ে ধরে বলে দাদু ভাই। কি হলো দাদু তুমি কাঁদো কেন? “তোর দাদীর কথা মনে পড়ে গেলরে। তোর দাদী অপূর্ব সুন্দরী ছিল, আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম বলে পাক সেনারা এদেশের নর পিশাচদের সহযোগিতায় ওরা তোর দাদীকে তুলে নিয়ে যায় তারপর যা হবার তাই হলো- কি হলো দাদু ভাই? ওরা তোর দাদীকে আর বলতে পারলোনা শের আলী, কিছুক্ষন কাঁদলো তার স্ত্রীর কথা ভেবে, তারপর আবার বলতে শুরু করলো তোর দাদী অপমান সহ্য করতেনা পেরে এই মরিচ্চাপ নদীতে ঝাপ দিলো কদিন পরতোর দাদীর লাশ বেসে উঠলো। তোর বাবা তখন খুব ছোট। দাদু ভাই তোমার কি দাদীর কথা মনে পড়ছে? হ্যাঁ। আজ আমার তোর দাদীর কথা খুব মনে পড়ছে। এদেশের জন্য স্বাধীন পতাকার জন্য আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছি। আমার পা হারিয়েছি। আমার ছেলে হারিয়েছি। এত কিছু হারানোর বিনিময়ে যে স্বাধীনতা পেলাম, সে স্বাধীনতা আমার কি দিল বল কি দিল? শের আলী প্রলাপ বকতে লাগলো। মেহের শুধু শুনলো কোন কথার উত্তর দিতে পারলোনা কারণ এ কথার উত্তর মেহের আলির জানা নেই। মেহের বলল খুব ঠান্ডা পড়েছে। চলো দাদু বাড়ী যাই। না-রে মেহের না এই মরিচ্চাপ নদীতে তোর দাদী শুয়ে আছে, এই মরিচ্চাপ এর তীর বেয়ে কত যুদ্ধ করেছি। এই মরিচ্চাপ জুড়ে আমার বহু স্বপ্ন বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওর পাশে আমার কিছুক্ষন থাকতে হবে (দাদুভাই) অসহায় শিশুর মতো করুন আকুতি শের আলীর। বিজয় দিবসের সকালে গ্রামেরবিভিন্ন স্কুলে অনুষ্ঠান থেকে মাইকে ভেসে আসছে সেই জন প্রিয় গান গুলি, আমার সোনার বাংলা আমিতোমায় ভালোবাসি, ছালাম ছালাম হাজার ছালাম, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, সবকটা জানালার খুলে দাও দার। স্কুল, কলেজের ছেলেরা গায়ে জাতীয় পতাকার রঙে জমা পরে নদীর ধার দিয়ে অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। মনে তাদের বিজয়ের প্রেরণা, কণ্ঠে দেশের গান, ওরা একদিন বড় হবে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় ওরা কঠিন ভূমিকা রাখবে, শের আলীর বড় ভালো লাগলো ছেলেদের এ জাতীয় পোষাক দেখে শেরআলী ওদের গতিরোধ করে বললো দাঁড়াও কোথায় যাচ্ছ তোমরা? “বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে”। তোমাদের কিছু বলার দরকার বলুন তোমরা যে পোষাকটা পরেছ এরকি অর্থ বহন করে জানো? জানি, এটা জাতীয় পাতাকা, এটা বাংলা দেশের অস্তিত্ব, এটা বাংলাদেশ। হ্যাঁ, বাবারা, বাংলাদেশকে শুধু পোষাকে ধরলে হবে না, মনে ধারণ করতে হবে মনে। ছেলেরা শুধু বলে গেল, দোয়া করবেন চাচা আমরা যেন আপনার কথা রাখতে পারি। শের আলী চেয়ে আছে ছেলে গুলোর দিকে, ওরা এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। শের আলী আবার চোখ রাখে মরিচ্চাপ নদীতে। নদীর সে গর্জন নেই আর। নেই সেই ভয়ঙ্কর তান্ডব, সেই নদী আজও বয়ে যায় নিরবে নিভৃতে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আব্দুর রহমান
লেখা পাঠানোর ইমেইল: sahityapata24@gmail.com