আব্দুর রহমান: বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ কনস্টেবলরা, যাদের ত্যাগে আইন-শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। দেশে মোট পুলিশের প্রায় ৮০ শতাংশই কনস্টেবল, যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণেই সমাজে শান্তি ও স্থিতি বজায় থাকে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেয়ে নীচের স্তরে থাকা এই কনস্টেবলরা সবার আগে ঝুঁকি নিয়ে পথে নামেন, দায়িত্ব পালন করেন দিন-রাত নির্বিশেষে। কিন্তু তাদের জীবনমান সেই পরিমাণ সুরক্ষা বা মর্যাদা পায় না, যা তাদের কঠোর দায়িত্বের সঙ্গে মানানসই। একজন নবনিযুক্ত কনস্টেবলের বেতন মাত্র ১৪,৯০০ টাকা, যা বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে অত্যন্ত অপ্রতুল।
জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় একজন গড় ব্যক্তির মাসিক খরচ গড়ে ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা, যা অধিকাংশ কনস্টেবলের আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থের এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রায় ৭০ শতাংশ কনস্টেবল পরিবার থেকে দূরে থেকে অর্থ বাঁচানোর চেষ্টা করেন, যা তাদের পারিবারিক জীবনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, কনস্টেবলরা মাসিক রেশনের আওতাভুক্ত হলেও, তাদের বেতন বৃদ্ধি বা ভাতা নিয়ে কার্যত তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। পুলিশের কল্যাণ তহবিলে প্রতিমাসে যে অর্থ কাটা হয়, তা অবসরকালীন সহায়তার জন্য বরাদ্দ থাকলেও তাৎক্ষণিক সমস্যায় তহবিল থেকে সহায়তার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
কনস্টেবলরা সপ্তাহে প্রায় ৭ দিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওভারটাইম হিসাবে গণ্য হয় না। ২০২৩ সালে, পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ গবেষণায় দেখা গেছে, পুলিশের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও মানসিক চাপ একটি সাধারণ সমস্যা। প্রতি ১০ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৭ জন অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং পারিবারিক দূরত্বজনিত বিষন্নতায় ভুগছেন। নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের বিষয়টি এ অবস্থায় অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে, যা উন্নত দেশগুলোর পুলিশ বাহিনীতে একটি সাধারণ চর্চা।
বাংলাদেশ পুলিশ কেবল আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতেই নয়, বরং বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক সেবা কার্যক্রমেও অবদান রাখছে। ২০২৩ সালে, ৯৯৯ জরুরি সেবা লাইনে প্রায় ৬০ লাখ কল গ্রহণ করা হয়, যা দেশে মানুষের পুলিশের প্রতি আস্থার প্রতিফলন। তবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় (বিশেষত সাইবার ক্রাইম ও মাদক সংক্রান্ত অপরাধ) পুলিশের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক কনস্টেবল তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।
পুলিশ বাহিনীকে মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে শক্তিশালী করতে কল্যাণ ও কিছু বিশেষায়িত প্রকল্প চালু থাকলেও, তা কনস্টেবলদের তাত্ত্বিক নিরাপত্তা প্রদানে কার্যত অপ্রতুল। এমনকি বেশিরভাগ কনস্টেবলই আর্থিক সংকট মেটাতে বেসরকারি ঋণগ্রহীতাদের সহায়তা নিতে বাধ্য হন। ফলে, এদের অনেকেই ঋণের চক্রে পড়ে যান, যা তাদের মানসিক চাপ এবং হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কনস্টেবলদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: বেতন ও ভাতার কাঠামো পুনর্বিবেচনা, যাতে তা বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
সপ্তাহে কমপক্ষে একদিনের ছুটি এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য ওভারটাইম প্রদানের নিয়ম নিশ্চিত করা। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়ন করা, যাতে ঘুষ বা তদ্বিরের প্রয়োজন না হয় এবং যোগ্য প্রার্থীদের স্থান নিশ্চিত হয়। যে মানুষগুলো নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমাদের এই দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, পুলিশ বাহিনী শুধুই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, এটি একটি পরিবারের মতো যেখানে সদস্যদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কনস্টেবলদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা না শুধু তাদের প্রতি সম্মান জানাবো, বরং
পুরো বাহিনীর কার্যক্ষমতাকেও আরও উন্নত ও মানবিক করে তুলবো।