ড্রোন হলো আধুনিক প্রযুক্তির একটি অনন্য উদ্ভাবন, যা দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বা স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত মানববিহীন গগনচারী যান। মূলত উড্ডয়ন ক্ষমতাসম্পন্ন এই রোবোটিক ডিভাইসটি বিভিন্ন উচ্চতায় ওড়ার পাশাপাশি স্থলভাগের উপরে অবস্থান গ্রহণ, ছবি তোলা, তথ্য সংগ্রহ এবং পরিবহনেও সক্ষম। এই গুণাবলির জন্য ড্রোন বর্তমানে প্রতিরক্ষা, সামরিক অভিযান, নজরদারি, পণ্য ডেলিভারি, আবহাওয়া পূর্বাভাস, কৃষি, চলচ্চিত্র এবং ফটোগ্রাফি সহ নানা খাতে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি ড্রোন ব্যবহারে বাংলাদেশের আকাশসীমায় নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) কর্তৃক “ড্রোন বিধিমালা ২০২৪” এর খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন এ বিধিমালায় ড্রোন উড্ডয়ন, আমদানি, নিবন্ধন এবং ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী ও শর্তাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। জননিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার স্বার্থে কঠোরভাবে এসব নিয়ম মেনে ড্রোন পরিচালনার অনুমতি নিতে হবে।
এই খসড়ায় খেলনা ড্রোন ছাড়া অন্য সব ড্রোনের জন্য প্রতি উড্ডয়নের পূর্বে লাইসেন্স গ্রহণ, আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। ড্রোন আমদানির ক্ষেত্রেও প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে তিনটি শ্রেণিতে ড্রোন বিভক্ত করা হয়েছে: খেলনাজাতীয়, সাধারণ ড্রোন, এবং মানুষ ও পণ্যবাহী ড্রোন। প্রতিটি শ্রেণির জন্য উড্ডয়ন এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
এতদ্বারা খেলনাজাতীয় ড্রোন অনুমতি ছাড়া গ্রিন জোনে সর্বোচ্চ ১০০ মিটার উচ্চতায় ওড়ানো যাবে। ইয়েলো জোন, যেমন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও সভা-সমাবেশে, বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। সামরিক অঞ্চলসহ রেড জোনে ড্রোন পরিচালনা করতে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর অনুমতি ছাড়াও বেবিচকের বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন।
এছাড়া খসড়ায় ড্রোনের নিবন্ধন ও পরিচিতি নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমদানির সময় জননিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিভাগের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে। এ ধরনের বিধিমালা প্রণয়ন ড্রোনের অপব্যবহার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড্রোন ব্যবহারের প্রধান ক্ষেত্র: ড্রোনের ব্যবহার মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অধিক প্রাধান্য পাচ্ছে:
- সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে: শত্রুপক্ষের গতিবিধি নজরদারি, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আক্রমণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ড্রোন বিশেষ কার্যকর।
- নজরদারি ও পর্যবেক্ষণে: সীমান্ত বা দুর্গম এলাকায় নজরদারি এবং বিপদপূর্ণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ড্রোন ব্যবহৃত হয়।
- কৃষি: ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, কীটনাশক প্রয়োগ এবং ফসলের মাঠের ম্যাপিংয়ে ড্রোনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
- বাণিজ্যিক ও মিডিয়া খাতে: চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ, ইভেন্ট কাভারেজ এবং পণ্য পরিবহনে ড্রোনের ব্যবহার জনপ্রিয়।
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও আগুন নিবারণে: এআই চালিত ড্রোন প্রযুক্তি দাবানলের আগাম পূর্বাভাস ও নির্ধারিত এলাকায় আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
ড্রোন ব্যবহারের আইনগত বিধিনিষেধ: ড্রোন ব্যবহারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন ও বিধিনিষেধ রয়েছে, যা সাধারণত নাগরিকদের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা রক্ষা এবং বৈধভাবে ড্রোন ব্যবহার নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে ড্রোন পরিচালনা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু মূল বিধিনিষেধ রয়েছে: বিস্তারিত দেখুন
- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন: ড্রোন পরিচালনার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB)-এর অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অনুমতি ছাড়া বাণিজ্যিক, গবেষণা কিংবা বিনোদনমূলক কাজে ড্রোন পরিচালনা নিষিদ্ধ।
- নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওড়ানো: ড্রোন উড্ডয়নের উচ্চতা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৪০০ ফুটের নিচে ড্রোন ওড়ানো যায়।
- নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও জনাকীর্ণ স্থানে নিষেধাজ্ঞা: সামরিক, সীমান্ত ও নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ড্রোন ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
- ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ: জনসমাবেশ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা আবাসিক এলাকায় ড্রোন ব্যবহারে গোপনীয়তা ভঙ্গ না করা বাধ্যতামূলক।
- রেজিস্ট্রেশন এবং ফ্লাইট লগ রক্ষণাবেক্ষণ: কিছু ক্ষেত্রে ড্রোন রেজিস্ট্রেশন এবং উড্ডয়নের ফ্লাইট লগ সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক।
আইন লঙ্ঘনের পরিণাম: ড্রোন ব্যবহারের নিয়ম লঙ্ঘন করলে জেল, জরিমানা, ড্রোন জব্দ বা অন্যান্য আইনি শাস্তির বিধান রয়েছে।
“ড্রোন বিধিমালা ২০২৪” এর খসড়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ড্রোনের ব্যবহার, আমদানি, নিবন্ধন এবং পরিচালনা বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। নিচে খসড়ার মূল কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো:
১. ড্রোন শ্রেণিবিভাগ
- খেলনাজাতীয় ড্রোন: ২৫০ গ্রাম ওজনের কম, এবং অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা না থাকা ড্রোন।
- খেলনাজাতীয় ছাড়া অন্যান্য ড্রোন: সাধারণ বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত ড্রোন।
- মানুষ ও পণ্যবাহী ড্রোন: যাত্রী বা মালামাল পরিবহনকারী ড্রোন।
২. লাইসেন্স ও নিবন্ধন
- খেলনা ড্রোন ছাড়া সব ধরনের ড্রোনের জন্য CAAB-এর লাইসেন্স বাধ্যতামূলক।
- ড্রোন উড্ডয়নের জন্য প্রতিবার উড্ডয়নের পূর্বে CAAB-এর অনুমতি এবং সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
- ড্রোনের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, এবং নিবন্ধিত ড্রোনের পরিচিতি নম্বর থাকবে, যা CAAB দেবে।
৩. আমদানি ও তৈরি
- ড্রোন আমদানি করতে প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনুমতি বাধ্যতামূলক।
- জননিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিভাগের ছাড়পত্র এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে ড্রোন ও যন্ত্রাংশ তৈরি এবং সংযোজন কারখানা স্থাপন করা যাবে।
৪. ড্রোন উড্ডয়ন এলাকা নির্ধারণ
- গ্রিন জোন: অনুমতি ছাড়াই খেলনাজাতীয় ড্রোন ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট পর্যন্ত উড়ানো যাবে।
- ইয়েলো জোন: ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, জনসমাগমস্থল, বিমানবন্দরের ৩ থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে এলাকা, যেখানে অনুমতি সাপেক্ষে ড্রোন উড্ডয়ন করা যাবে।
- রেড জোন: সামরিক এলাকা, বিমানবন্দরের ৩ কিলোমিটার এলাকা, কেপিআই এলাকা, আন্তর্জাতিক সীমান্তের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ড্রোন ওড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বাহিনীর ছাড়পত্র ও CAAB-এর বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন।
৫. প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা
- খেলনা ড্রোন ছাড়া অন্যান্য ড্রোন পরিচালনার জন্য CAAB নির্ধারিত প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক।
- ড্রোন পরিচালকদের বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর হতে হবে এবং আকাশসীমা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে।
৬. নিয়ম লঙ্ঘনে শাস্তি
- অনুমতি ব্যতীত ড্রোন পরিচালনা বা বিধিমালা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন এবং CAAB আইন, ২০১৭ অনুসারে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
- অননুমোদিত স্থানে ড্রোন উড্ডয়নের মাধ্যমে যদি জননিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষতি হয়, তবে অপরাধী হিসেবে শাস্তিযোগ্য বিবেচনা করা হবে।
৭. রাতে উড্ডয়ন
- রাতের বেলায় ড্রোন উড্ডয়ন CAAB-এর অনুমতি ছাড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তবে খেলনা ড্রোন এ বিধিনিষেধের আওতায় আসবে না।
৮. বিশেষ বিধান
- ড্রোন উড্ডয়নের আগে আকাশ প্রতিরক্ষা কেন্দ্র, ডিজিএফআই, এনএসআই, বিজিবি এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বিভাগ থেকে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।
- অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন অনুসারে ড্রোন আমদানি ও পরিচালনার জন্য CAAB-এর নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে হবে।