স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম কৃষি খাত। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গত দুই বছরে করোনার প্রকোপে যখন জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে ধস নেমেছিল, তখন কৃষি খাতই আমাদের দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে পেরেছিল। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সুনজর পড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। দেশে তৈলবীজ উৎপাদনও বেড়েছে। এগুলো সরকারের সুদৃষ্টিরই নমুনা। চলতি অর্থবছরে দেশের কৃষিপণ্যের রপ্তানি মূল্য দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদিত দ্রব্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে যৌক্তিক বাধা যে নেই তা নয়, তবে সেগুলো সমাধানের বিকল্প তাত্ত্বিক কৌশলও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৮ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে এ দেশের কৃষিতে সরকারি সহায়তা একপ্রকার অনস্বীকার্য।
করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বেড়েছে যথাক্রমে প্রায় ২৭৭ ও ২৪২ শতাংশ। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি বা প্রধান উপকরণগুলোর দাম বাড়লে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। উৎপাদিত দ্রব্যের দাম আনুপাতিক হারে না বাড়লে তাতে তিনি ক্ষতির মুখে পড়েন এবং উৎপাদন বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে কৃষকের হাত রয়েছে কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে, অর্থাৎ বাজারব্যবস্থার ওপর তাঁর কোনো হাত নেই। ফলে উৎপাদন নিয়ে কৃষক সর্বদা দুশ্চিন্তায় থাকেন। এছাড়াও সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ক ছাড় দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে কৃষক তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্য নিয়ে পড়েন বিপাকে। পড়তে হয় ক্ষতির মুখে এবং যার প্রভাব পড়ে পরের বছরের উৎপাদনে। সেজন্য কৃষি উৎপাদন সচল রাখতে সারসহ কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে; বাড়াতে হবে কৃষিতে বাজেট বরাদ্দও। প্রয়োজনে অন্যান্য খাতের প্রণোদনায় ভর্তুকি কমাতে হবে। এতে যেমন ডলারের সংকটও কমবে, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানসম্মত দেশীয় পণ্যের একটি বিশাল বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অন্য কোনো অজুহাতে কৃষিতে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর দাম বাড়াতে হয়-এমন নীতি গ্রহণ থেকে সরকারকে যেকোনো মূল্যে বিরত থাকতে হবে।
কৃষক পর্যায়ে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনের কারণে আমাদের দেশের কৃষকদের তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে। এখান থেকে প্রাকৃতিকভাবে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য কৃষকদের জৈব সার তৈরিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। তাঁদের ফসল ব্যবস্থাপনা ও সার ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর রাসায়নিক সার উৎপাদনে পর্যায়ক্রমে অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বাড়ানো অনেক বেশি জরুরি এবং সে লক্ষ্যে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া সিমেন্টের মতো দেশের চাহিদা মিটিয়ে রাসায়নিক সার রপ্তানি করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। একই সঙ্গে রাসায়নিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বিশাল এক বাজার সৃষ্টিসহ অনেক মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই আসন্ন বাজেটে কৃষি খাতেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ আসা উচিত।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আব্দুর রহমান
লেখা পাঠানোর ইমেইল: sahityapata24@gmail.com