আমাদের কাচারি ঘরের নিচে একটা বাচ্চার কবর আছে। যার কবর সে বেঁচে থাকলে এতোদিনে তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতো। সে হতো আমার বড়ো চাচা। তখন আমার বড়ো চাচার নাম হতো জসিম। কিন্তু এখন আমার বড়ো চাচার নাম মিলন। বড়ো চাচা আমার বাবার বয়সের ব্যবধান মাত্র এক মিনিটের। তারা দুজন যমজ ভাই। জন্মের পর বড়ো চাচার ওজন সামান্য বেশি হওয়ায় তার নাম রাখা হয় মিলন। তার বাবার ওজন সামান্য কম হওয়াতে বাবার নাম হয় মীলন। তাদের দুজনের একই নাম শুধু বানানের সামান্য পার্থক্য; কিন্তু অর্থের দিক থেকে একে অন্যের সম্পূর্ণই বিপরীত। মিলন মানে সংযোগ আর মীলন অর্থ সংকোচন। নামের দিক থেকে একে অন্যের বিপরীত হলেও বড়ো চাচা আর বাবার মাঝে তেমন বিপরীতার্থক কিছু নেই। তারা দুজনেই খুব বেশি কথা বলে। প্রয়োজন – অপ্রয়োজনে শুধু কথা। তারা দুজনে যত কথা বলে সেগুলো সাহিত্যের ভাষায় গুছিয়ে লিখলে দুজনেই দেশের নামকরা কথা সাহিত্যিক হতে পারতো।
গতকাল বাবার জন্মদিন ছিল। আমি আর আমার ছোটো বোন মিলে সব কিছু সাজিয়েছি। আমরা দুবোন বাড়ি থেকে খুব একটা বের হইনা, ইচ্ছা করে যাই না বললে ভুল হবে। আসলে আমাদের বাহিরে যেতে মানা আছে। কি কারণে মানা আছে সে কথা আজ থাক। দারোয়ানকে দিয়ে বাবার জন্য কেক আনিয়েছি। আমরা ভেবিছিলাম বাবা খুব খুশি হবে আমাদের উপর কিন্তু হলো তার উলটো টা। আমরা দুবোন যেয়ে বাবাকে তার ঘর থেকে নিয়ে এলাম কেক কাটার জন্য। তিনি এসে কেক দেখে খুব অবাক হলেন, তিনি জানতেন না আজ তার জন্মদিন। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘কেক কিসের?’
আমার ছোটো বোন নীলিমা বলল- ‘কি বলছো বাবা তুমি জানো না!’
বাবা বলল- ‘না, জানি না। না বললে কি ভাবে জানবো!’
আমি বললাম- ‘বাবা আজ তোমার জন্মদিন। কাটো কেক কাটো। ঐযে ঘরিতে দেখো বারোটা এক মিনিট হয়ে গেছে।’
বাবা আমাদের দিকে তাকিয়ে কেক কেটে দুজনকে অল্প একটু করে খাইয়ে দিল। বাকিটাকে দারোয়ানকে দিয়ে দিতে বলল। বলে সে তার ঘরে চলে গেলো। বাবা কেক খেলো না। যাওয়ার আগে গোমড়ামুখে আমাদের বলে গেলো আমরা যেন দারোয়ানকে কেকটা দিয়ে এসে তার ঘরে যেয়ে তার সাথে দেখা করি। নীলিমার খুব মন খারাপ হলো, কারণ জন্মদিন পালনের প্ল্যানটা তারই ছিল। নীলিমা রাগ করে ওপরে চলে গেছে। আমি দারোয়ানকে কেকটা দিয়ে এসে নীলিমার কাছে গেলাম। যেয়ে দেখি সে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। এটুকু বিষয় নিয়ে কাঁদার কিছু নেই। কিন্তু সে কাঁদছে। আমাদের বাড়িতে সবারই একটা করে দোষ আছে। বড়ো চাচা আর বাবার দোষ হচ্ছে কথা বেশি বলা, দারোয়ানের দোষ হচ্ছে সারাদিন ভিডিয়ো কলে কথা বলা, আর নীলিমার দোষ হচ্ছে ছোটো-বড়ো সব বিষয় নিয়েই কান্নাকাটি করা। চোখের পানি খুব মূল্যবান জিনিস, অনর্থক কাজে তা ব্যয় করা ঠিক না। আমরা অনেক সময় অন্যের ছেড়ে যাওয়াতে চোখের পানি ফেলি; তা উচিত না। হৃদয়ের বন্ধনে যাকে আবদ্ধ করা যায় না তাকে চোখের পানিতে আটকে রাখার চেষ্টার কোনো অর্থ নেই। আমি নীলিমার পাশ দিয়ে এসে তাকে বললাম- ‘বাবা তুকে ডাকছে।’
সে মাথা উঁচু করে আমাকে ঝারি দিয়ে বলল- ‘যা এখান থেকে।’
আমি আর তাকে কিছু বললাম না। আগে সে কান্নাকাটি করলে আমি তাকে বুঝাতাম, এখন আর বুঝাই না। তাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হয় না, অযথা নিজের সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমি বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষন পর নীলিমা টেবিল থেকে মাথা উঁচু করে আমাকে ডাকল- ‘হিমা।’
আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম –‘বল।’
তারপর সে প্রতিবারের মতোই আমাকে জরিয়ে ধরে কিছু সময় কাঁদলো।
আজ সকাল থেকে বাড়িটা কেমন ভার ভার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়িতে বিশাল কিছু ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটেছে, যা আমরা দুবোন জানিনা৷ আচ্ছা বাড়িতে কি কি হতে পারে! বিস্ময়বোধক ঘটনা গুলো এমন হতে পারে- ছোটো চাচা ফট করে বিয়ে করে কোনো একটা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এলো অথবা নীলিমা তার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেলো, পালিয়ে তারা বিয়ে করলো অথবা শিলা তার ছেলেকে নিয়ে ফট করে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো। অথবা বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলো। ছোটো চাচা বিয়ে করলে তেমন কিছুই হবে না। বাবা আর বড়ো চাচা কিছুক্ষণ বকাবকি করে তারপর নতুন বউকে ঘরে নিয়ে যাবে। নীলিমা তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেলে বাবা আর বড়ো চাচা গিয়ে থানায় নিখোঁজ মামলা দিবে, পুলিশ তাদের খুঁজে বের করবে তারপর তাদেরকে বকাবকি করবে দু-এক সপ্তাহ রাগ করে বাড়ির কেউ তাদের সাথে কথা বলবে না। তারপর গিয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা যদি ফট করে একটা মহিলাকে বাড়িতে নিয়ে এসে বলে- আজ থেকে ইনি তোমাদের মা। তোমরা তোমাদের মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা কিছুই পাওনি। এতোদিন তোমরা মায়ের যে শূন্যতা অনুভব করেছ, আজ থেকে তোমাদের আর সেই শূন্যতাটা নেই। বাবা এরকম বললে আমরা দুবোন তখন কি করবো! বড়ো চাচাই বা কি করবে! আমরা কি সে মহিলাকেই মা মা বলে ডাকবো! এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখি একজন লোক আমাদের ঘরের দরজায় এসে বসে আছে। লোকটা দেখতে অনেকটাই অদ্ভুত। পড়নে লাল সালু কাপড় প্যাঁচানো, গলায় বিভিন্ন রকমের তসবি ঝুলানো, মাথায় লম্বা লম্বা জট বাঁধা চুল, হাতের দশ আঙুলে পাথরের দশটা আংটি। লোকটাকে দেখে আমি দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম বাবার ঘরে একজন মহিলা বসে আছে, বাবা সেখানে নেই। মহিলাটা দেখতে অবিকল মায়ের মতো। মায়ের চেহারা এখন আর আমার স্পষ্ট মনে নেই তবে মায়ের ছবির সাথে ভদ্র মহিলার বেশ মিল। ভদ্র মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে সে আমার অনেক দিনের পরিচিত কেউ। যেন তার সাথে আমার অনেক বছর পর দেখা। আমি ভদ্র মহিলাকে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি?
ভদ্র মহিলা আমার প্রশ্নে খুব বিব্রতবোধ করলো। সে জবাব দিতে দিতেই বাবার ঘরে নীলিমা ছুটে এসে বাবাকে ডাকলো। তাকে খুব উজ্জীবিত দেখাচ্ছে। আমি বললাম, বাবা এখানে নেই। নীলিমা আমার হাত ধরে টেনে সেই লোকটার কাছে নিয়ে গেল। নিয়ে বলল- চাচা দেখেন তো ওর কি রাশি? ওর কপালে কি আছে? লোকটা তখন চোখ উঁচু করে আমার দিকে তাকালো৷ আমি নিজ অজান্তেই লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
সকাল থেকে বাড়ি ভার ভার মনে হচ্ছে কিন্তু তেমন কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি৷ ভেবেছিলাম ঐ লোকটা বোধহয় কিছু একটা বিস্ময়ের কাণ্ড ঘটাবে। তবে সেরকম কিছু ঘটেনি৷ আমি আর নীলিমা বারান্দায় বসে আছি। আমরা বসে গান শোনছি৷ যখন আমাদের কিছু ভালো লাগে না তখন আমরা দুজন বারান্দায় বসে গান শোনি; প্রেমের গান না, বিচ্ছেদের গান শুনি।
২.
শহর আর গ্রামের মাঝামাঝি সীমান্তে আমাদের বাড়ি। এটাকে না শহর বলা যায় না বলা যায় গ্রাম। আমাদের দুবোনের বৈশিষ্ট্যও ঠিক এরকম একটা মাঝামাঝি পর্যায়ের। এজন্য কিছু একটা করতে গেলে দ্বিধায় পরতে হয়৷ নীলিমা চাইছে বাড়ির পেছনের যে খোলা মাঠ সেখানে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে। সে সারা দুপুর খেটে মোটামুটি বড়ো আকারের একটা ঘুড়ি বানিয়েছে। কিন্তু বের হওয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিনা৷ একবার মনে হচ্ছে লোকে যা ইচ্ছা বলুক তাতে কার কি! আবার মনে হচ্ছে লোকে কি বলবে! বাবা আর বড়ো চাচা যদি বকাবকি করে! হঠাৎ খেয়াল করলাম বাহিরে বাড়ির গেইটে এসে কেও আমাদেরকে নাম ধরে ডাকছে। কণ্ঠটা একেবারেই অপরিচিত। আমাদের বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যাই দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন অপরিচিত মানুষজন এসে ভিড় জমান, তারা সবাই বাবার কাছে আসে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে। তারা কেউ আমাদেরকে চিনেনা৷ বাড়িতে কয়েকবার এলে হয়তো রাস্তাঘাটে কিংবা অন্য কোথাও দেখে চিনতে পারে যে এরা সৈয়দ উলিকের মেয়ে। কিন্তু তারা আমাদের নাম জানেনা৷
এইতো সেদিন আমি নীলিমা আর পূরবী মিলে ঠিক করলাম বাহিরে দূরে কোথাও চা খেতে যাবো। দিনের বেলা যাওয়া যাবে না। বাবা আর বড়ো চাচার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে বের হতে হবে৷ পূরবীর বাবার গাড়ি আছে। সে গাড়ি নিয়ে আসবে৷ তার গাড়িতে করেই যাবো। বিখ্যাত কোথাও চায়ের জন্য যাবো না৷ দূরে একেবারে গ্রাম্য একটা পরিবেশে যাবো। ঘন কুয়াশার ছেয়ে যাবে চারপাশ, পথের দ্বারে ছোটো একটা চায়ের দোকান, সেখানে একটা টিভি থাকবে। টিভিতে পুরানো দিনের বাংলা সিনেমা চলবে। গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষেরা সেখানে হাত-পা জোট বেধে বসে এক ধ্যানে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকবে। ভিলেন নায়ককে মারলে তারা কষ্ট পাবে – আফসোস করতে থাকবে আবার নায়ক ভিলেনকে মারলে তারা গায়ের জোশ ভিরে পাবে। সিনেমার শেষটা কি হয় সেটা দেখার জন্য তারা অধির আগ্রহে শীতল বাতাস পাশ কাটিয়ে টিভির দিকে চেয়ে থাকবে। আমরা যেয়ে দোকানের সামনে গাড়ি থামাবো৷ গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই তারা সবাই আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে৷ আমরা তিনজন দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাবো। ড্রাইভার আমাদের সিগারেটে আগুন দেবে….। রাতে বাবা আর বড়ো চাচার চোখ ফাঁকি দিয়ে যেমনটা ভেবেছি ঠিক তেমনি একটা দোকানের সামনে যেয়ে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা মানুষ গুলোও আমাদের দিকে সেভাবেই হা করে তাকিয়ে থাকে। দোকানের সামনে যেতেই দোকানদার আমার আর নীলিমার দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর অতি উত্তেজিত হয়ে বলে- ‘আপা আপনেরা আইছেন! হায়হায় আমার কি কফাল! কই বইতে দেই! ওই মিজাইন্না হালারপুত চেয়ান আন।’ লোকটার আচরণে আমরা খুব অবাক হলাম! সে কেনো আমাদেরকে এতো আপ্যায়ন করছে! আমরা তো তাকে চিনিই না। আমরা যেই ভাবনা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম এখানে পুরোটাই তার উলটো হচ্ছে৷ আমাদেরকে বসার জন্য চেয়ার এনে দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমরা অবলার মতো দোকানের বেঞ্চে বসেছি। এর আগে আমাদেরকে দেখে কেউ এমন আপ্যায়ন দেখায়নি। দোকানদার লোকটার বয়স মিনিমাম পঞ্চাশ হবে। আমাদের থেকে বয়সে এতো বড়ো একজন লোক আমাদেরকে এমন ভাবে আপ্যায়ন করছে মনে হচ্ছে আমরা যেন বিশাল কিছু! লোকটাকে একবার বলতেও পারছিনা যে সে আমাদের অপরিচিত। লোকটা নিজ থেকেই সব কথা বলতে থাকে৷ আমরা শুধু হা-না-হুম বলে যাচ্ছি। লোকটা আমাদের নাম জানতো না৷ কথার ফাঁকে আমাদেরকে আমাদের নাম জিজ্ঞেস করে৷ দোকানদার লোকটা নাকি একবার বিপদে পরে বাবার কাছে গিয়েছিল। বাবা নাকি তাকে কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই তার সে বিশাল বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে৷ সে আমাদের চেহারা মনে রেখেছে সৈয়দ উকিলের মেয়ে হিসেবে৷ এমন অনেকেই আছে যারা আমাদের নাম জানে না কিন্তু বিভিন্ন জনের পরিচয়ে আমাদেরকে চিনতে পারে, আমাদের চেহারা তারা মনে রাখে অথবা মনে থাকে৷ কিন্তু বাহিরে বাড়ির গেইটে এসে যে লোকটা ডাকছে, সে আমাদের নাম ধরে ডাকছে । নীলিমা যেয়ে গেইট খুলে দিল। গেইট খুলে আমরা দেখি সেখানে কেউ নেই!
প্রতি বৃহস্পতিবার বাবাকে আমরা অন্য রকম ভাবে দেখি৷ সেদিন সে একটা কালো পাঞ্জাবি পরে তার ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকে ইজিচেয়ারে বসে থাকে একটা পুরানো ডায়েরি হাতে। আমরা দরজার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে এসে তাকে দেখি। সেদিন তার বেশি কথা বলার অভ্যাসটা থাকে না। বৃহস্পতিবার তার সপ্তাহিক ছুটির দিন৷ সেদিন তার চেম্বার বন্ধ থাকে৷ যতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাই হোক না কেন বাবা সেদিন সেগুলো দেখে না৷ আজ বৃহস্পতিবার। বাবা তার ঘরের দরজা আটকে ইজিচেয়ারে পুরানো ডায়েরি হাতে বসে আছে৷ বাবা আমাকে তার ঘরে ডাকে। আমি যেয়ে বললাম,
– আমাকে ডেকেছ বাবা?
– হ্যাঁ। নীলিমা কই? যা ওকে নিয়ে আয়।
আমি নীলিমাকে ডেকে আনি। বাবা ইজিচেয়ারে দোলতে দোলতে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমার জন্মদিনের উৎসবটা তোমরা যেভাবে পালন করতে চেয়েছিলে সেভাবে পারোনি। এতে তোমাদের দোষ দিচ্ছি না। আমার জন্মদিন ২৯ শে ফেব্রুয়ারি। অন্যদের মতো বছর ঘুরেই আমার জন্মদিন আসেনা। আমার জন্মদিন নিয়ে তোমাদের যেমন বিভিন্ন রকম প্ল্যান থাকে, তেমন আমারও থাকে৷ কিন্তু সেদিন ২৯ শে ফেব্রুয়ারি আমার জন্মদিন যেমন ছিল তেমন বৃহস্পতিবারও ছিল, তোমাদের মায়ের মৃত্যু দিন৷ তার মৃত্যুদিনে আমার জন্মদিন পালিত হবে…। বলতে বলতে বাবার চোখ থেকে অঝোরে পানি পরতে থাকে৷ আমারও চোখ ভিজে যায়। নীলিমা অন্য সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেও আজ সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে।
রাত গভীর হলে নীলিমা কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করে৷ সে সারাদিন আমার সাথে কাটালেও গভীর রাতে সে একা থাকতে চায়; ছাদে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা আটকে দেয়৷ তাকে কত করে ডাকি সে দরজা খুলতে চায়না। ফজরের আজান হলে সে হোট করে ছাদের দরজা খোলে বেরিয়ে আসে৷ তখন তার গা থেকে মুগ্ধময় ঘ্রাণ বের হয়। রাত গভীর হলে তার ছাদে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ জানতো না৷ বাড়ির বাহিরের লোকেদের মধ্যে একমাত্র পূরবী জানে এ বিষয়ে। সে আমাদের দুবোনের খুব কাছের বন্ধু। সে জানলে কোন অসুবিধে নেই। প্রথম কয়েকদিন তার এ বিষয় নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। ভেবেছিলাম বাবা আর বড়ো চাচাকে এ বিষয় বলবো কিন্তু পরে আর বলা হয়নি। এখন বিষয়টা আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেছে। এখন রাত দুটা ছত্রিশ মিনিট। গভীর রাত! রাত গভীর হতেই নীলিমা চলে যায় ছাদে৷ যেয়ে সে ভিতর থেকে দরজা আটকে দেয়। আমি বিছানায় অন্ধকারে একাকার হয়ে যাই।
বাবা তার সহকারী হিসেবে চিন্ময় নামের একটা হিন্দু ছেলেকে নতুন নিয়োগ দিয়েছে৷ সে আজ থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে৷ নীলিমা প্রথম দেখাতেই চিন্ময়ের প্রেমে পরেছে, সে এটা আমাকে বলেনি তবে তার ভাবভঙ্গি দেখে অনেক কিছুই টের পাওয়া যায়। মেয়েরা সব সময় তাদের প্রেম সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গোপন করতে চায়। পিরিয়ড থেকে তারা প্রথমে তাদের গা গোপন শিখে, তারপর এই শিক্ষাকে আজীবন আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়; অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয়কেও তারা গোপন রাখতে পছন্দ করে৷ চিন্ময় বাড়িতে আসার পর থেকে নীলিমা আয়নায় তার নিজেকে বারবার দেখে, বাড়িতে সে সাজগোজ করে থাকে। কেউ প্রেমে পরেছে এটা ধরার প্রথম লক্ষ্মণ হচ্ছে, সে আয়নায় নিজেকে বারবার দেখবে,অকারণে আয়নার সামনে যেয়ে ঘুরঘুর করবে। দ্বিতীয় লক্ষ্মণ হচ্ছে একা থাকতে চাওয়া। এ লক্ষ্মণগুলো নীলিমার মাঝে হান্ডেডে হান্ডেড৷ নীলিমার বয়স এখন পনেরো চলছে। যৌবনের ডেঞ্জার যুন হচ্ছে তেরো থেকে উনিশ বছর পর্যন্ত। ও যখন তখন প্রেমের জন্য যা খুশি করতে পারে৷ এই যেমন চিন্ময়কে সে প্রেমের প্রস্তাব দিল চিন্ময় তাতে রাজি হলো না। সে চিন্ময়কে পাওয়ার জন্য ব্লেট দিয়ে হাত কাটল অথবা অনেক গুলো ঘুমের বরি খেয়ে পরে থাকলো অথবা আরো বিপজ্জনক কিছু করে বসলো! চিন্ময়কে বাড়িতে আসা মাত্রই বের করি কি করে? এক মাস তো অন্তত সে এখানে থাকবে। এর মধ্যে নীলিমাকে চোখে চোখে রাখতে হবে৷ তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।
মায়ের মতো দেখতে বাবার ঘরে সেদিন যে ভদ্র মহিলাকে দেখেছিলাম। সে আজ আবার এসেছে। হয়তো খুব বিপদে পরেছে কোনো মামলা-মোকদ্দমার বিষয়ে। ভদ্র মহিলার নাম জুবাইদা নূর। একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষিকা। বাবা ঘরে না থাকায় তার সাথে আমার খানিকক্ষণ কথা হয়েছে। তারপর বাবা আসতেই আমি সেখান থেকে চলে আসি। ঘণ্টাখানেক পর জুবাইদা নূর বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। চিন্ময় তার পেছন পেছন যাচ্ছে।
সন্ধ্যার পর বাবা আর বড়ো চাচা চা খেতে খেতে আলাপ করছিল। তারা যখন আলাপ করে তখন আমি আর নীলিমা কান পেতে রাখি। তাদের কথা আমাদের কোনো কাজে আসে না। না শোনে মজা পাই, না অন্য কিছু৷ কিন্তু এটা আমাদের একটা বদঅভ্যাস হয়ে গেছে । না শোনলে মনে হয় কি বিশেষ কথা যেন তারা বাদ পরে গেল আর শোনলে মনে হয়, এসব অনর্থক কথা৷ বড়ো চাচা তাদের কথার মাঝ দিয়ে আমাকে ডাকলো৷ আমি আর নীলিমা তখন দরজার পাশ থেকে কান পেতে আছি। আমাকে ডাকতেই আমি থতমত খেয়ে যাই৷ বড়ো চাচা আমাকে আবার ডাকলো, হিমা – হিমা?
৩.
‘একটা বলবান শিয়াল মোটা একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। শিয়ালটাকে দূর থেকে অনেক লোক দেখছে আর সে শিয়ালটার পায়ে একটা ব্যাং তার মাথা ঘষছে।’ গত দুদিন ধরে আমি এই একই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি৷
সেদিনের সে অদ্ভুত রকমের লোকটা আজ আবার আমাদের বাড়িতে এসেছে৷ সেদিন এসে যে জায়গাটাতে বসে সে আমার আর নীলিমার হাত দেখেছে আজ ঠিক একই জায়গায় এসে বসেছে৷ তবে সেদিন বাড়িতে বাবা বড়ো চাচা তারা কেউ ছিল না কিন্তু আজ তারা সবাই আছে। লোকটাকে বাবা কোন রকম কথাবার্তা ছাড়াই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। আজকাল অনেকেই এমন সাধু-সন্ন্যাসীর ভেসে বাড়িতে ঢুকে দিন-দুপুরে চুরি ডাকাতি করে যাচ্ছে৷ লোকটাকে বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে গেলে নীলিমা আর আমি আপত্তি করে তার জাদুর খেলার কথা বাবাকে বলি। তখন বাবা কিছুটা শান্ত হয়৷ লোকটাকে প্রথমে আমরা বড়ো চাচার হাত দেখতে বলি। লোকটা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বড়ো চাচার অতীতের অনেক কথা গরগর করে বলে দেয়। বড়ো চাচা যেন লোকটার ক্ষমতা দেখে আত্মহারা হয়ে গেল। তিনি হাসতে হাসতে বললেন- পই পই সব মিলে গেছে। হাহাহহাহা! তারপর লোকটা বাবার হাত দেখতে চাইল। বাবা তখন তার ডান হাতটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিল।
প্রিয় চিন্ময়,
তোমার নামে লেখা প্রতিটি শব্দ যেন আমার হৃদয়ের গভীরতম কোণ থেকে উঠে আসা এক সুর। তোমার প্রতি ভালোবাসা এতটাই নিখুঁত, যেন আকাশের তারাদের মৃদু আলোয় খচিত কোনো নক্ষত্রপথ। তোমার হাসিতে, আমি খুঁজে পাই পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য। তোমার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, সেখানে এক অদ্ভুত মায়া লুকিয়ে আছে, যা আমাকে বারবার মোহিত করে তোলে।
তুমি যেন আমার জীবনের কবিতা, যার প্রতিটি পঙক্তিতে জড়িয়ে আছে সুধা ও স্নিগ্ধতা। তোমার অনুপস্থিতিতে মনে হয় যেন রাতের আকাশে চাঁদ হারিয়ে গেছে, আর তুমি পাশে থাকলে আমার পৃথিবীটা পূর্ণ হয়ে যায়। তোমার হাসি- তোমার কথা—সব কিছুতেই আমি খুঁজে পাই আমার অস্তিত্বের গভীরতম প্রশান্তি। আমার হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে তুমি চিরকালীন অতিথি, যার জন্য প্রতিটি স্পন্দন তোমার নামেই নিবেদিত। এই অমর ভালোবাসার কবিতায় তুমি প্রতিটি স্তবকের কেন্দ্রবিন্দু। তুমি ছাড়া আমার কবিতার কোনো মানে নেই।
আমি কেবল তোমার এক জোড়া চোখের বিবরণে লিখে যেতে পারি আমরণ-
থামবেনা লেখা, হয়ে যেতে পারে মহা বিশ্বের বিস্ফোরণ।
তোমার প্রতি এই গভীর ভালোবাসা চিরন্তন, যা কোনো কালেই ফুরাবে না। তুমি আমার দিনরাত্রির সঙ্গী, আমার জীবনের একমাত্র নক্ষত্র।
তীব্র রোদে মানুষ ছায়া খুঁজে-
একটু বাতাস খুঁজে-
খরায় যেমন বৃষ্টি খুঁজে,
তেমনি আমি প্রতি মূহুর্তে তোমায় খুঁজি-
অশান্তির অনল থেকে মুক্তির নেশায়।
চিন্ময় তার ঘরে টেবিলের উপর চিঠি পেয়ে এতোক্ষণ তা পড়ছিল। চিঠিটা তাকে কে লিখেছে সেটা বুঝতে তার দু সেকেন্ডও লাগবে না৷ এতোদিনে নীলিমার সাথে তার মোটামুটি চোখে চোখে কথাবার্তা হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করেনি। নীলিমা অপেক্ষা করছিল কিন্তু সেই আবার অপেক্ষার বেরা জাল ছিন্ন করে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করলো।
রাত্রির আগমনী সুর বেজে ওঠেছে। চারপাশ ঘন কুয়াশা আর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। আমি আর নীলিমা বাবার ঘরে গেলাম। যেয়ে দেখি সে বিছানায় হেলান দিয়ে আছে। আমি আর নীলিমা বাবার পাশ দিয়ে যেয়ে বসলাম। বাবা হাত থেকে বইটা বুকশেলফে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল- ‘আজকে যে লোকটা বাড়িতে এসেছিল তাকে দেখে তোমরা খুব বিস্মিত হয়েছ তাই না?’
আমরা হ্যাঁ সূচক মাথা নারলাম। তারপর বাবা বলল- ‘ছোটোখাটো এসব বিষয়ে কখনো বিস্মিত হবে না। তাহলে মানুষ তোমাদের বোকা ভাববে। আমি তোমাদের একটা বিষয় খেয়াল করেছি, তোমরা নিজেদেরকে সব জায়গায় খুব চতুরভাবে উপস্থাপন করতে চাও৷ এটাও তোমাদের একটা বোকামি। এই সমস্যাটা শুধু তোমাদের না, সব মানুষেরই এই সমস্যাটা আছে। মনে রাখবে সব জায়গায় তোমার মূল্য মানুষ বুঝবে না৷ যদি বুঝতো তাহলে পৃথিবীর কেউ দুঃখ পেতো না৷ এখন আমি তোমাদের সাথে একটা মজার খেলা খেলবো। তোমরা মনে মনে ২ সেকেন্ডের মধ্যে একটা ফুলের নাম ধরবে। ধরেছো?
আমরা হ্যাঁ সূচক মাথা নারলাম। তারপর বাবা চোখবন্ধ করে বলল, ‘তোমাদের সেই ফুলটার নাম গোলাপ। হয়েছে?’
আমরা বিস্মিত হয়ে একে অন্যের দিক তাকাতে থাকি। তারপর বাবা বলল, ‘এখন তোমরা মনে মনে একটা কালার ধরে নিবে।’ সাথে সাথেই আমরা মনে মনে কালার ধরে নিলাম এবং মাথা নেরে বাবাকে জানান দিলাম- হয়েছে। বাবা আবার তার চোখ বন্ধ করে বলল- ‘তোমরা যে কালারটা মনে মনে ধরেছো সেটা লাল। হয়েছে?’ আমরা আবারও বিস্মিত হয়ে একে অন্যের দিক তাকাতে থাকি। বাবা তখন বলল- ‘তোমারা কোন ফুল এবং কোন কালারটা মনে মনে ধরেছো সেটা আমার জানার কথা না৷ অথচ আমি বলে দিতে পেরেছি। এটা হচ্ছে হিউম্যান সাইকোলজি। আমাদের দেশের যে কোনো মানুষকে যদি তুমি ২ সেকেন্ড সময় দিয়ে বলো একটা ফুলের নাম বলতে সে প্রথমেই বলবে গোলাপ, যদি বলো রঙের নাম বলতে তাহলে সে প্রথমেই বলবে লাল। তার উপর ভিত্তি করেই আমি আন্দাজ করে বলেছি এবং তা সঠিক হয়েছে আর তোমরা তাতে বিস্মিত হয়েছ। আজ আমাদের বাড়িতে যে লোকটা এসেছে তাকে তোমরা অনেক গুপ্তবিদ্যা সম্পূর্ণ লোক মনে করছো। আসলে সে কিছুই না। সে হিউম্যান সাইকোলজির তেমন কিছুই জানেনা৷ তার কাজ হচ্ছে মানুষের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে পয়সা নেওয়া এবং সে সেটাই করছে ঘুরেফিরে। তার যে পোশাকটা দেখেছ সেটা মানুষের আস্থা পাওয়ার জন্য। আমরা আমাদের থেকে ভিন্ন রকম কিছুতে খুব সহজেই বিশ্বাস আনি। এর পেছনেও রয়েছে হিউম্যান সাইকোলজি। নারী আর পুরুষের রয়েছে লিঙ্গের ভিন্নতা। যে কারণে নারী পুরুষকে এবং পুরুষ নারীকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে নেয়। যা ফলে খুব দ্রুতই আবার বিশ্বাস ভেঙে যায় আর জন্ম নেয় বিচ্ছেদের আগ্নেয়গিরি।’
নীলিমা বলল,’বাবা লোকটা তো তোমার আর বড়ো চাচার অতীত বলে দিয়েছে। সে এটা কিভাবে বলল! আর সে যা যা বলেছে সবই তো সত্য সত্য বলল!’
বাবা হাই তুলতে তুলতে বলল,’সে যেগুলো বলেছে সেগুলো প্রতিটা মানুষের বেলায়ই ঘটে। সে বলেছে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মেয়ের প্রেমে পরেছিলাম। সেতো সবাই-ই পরে। তারপর বললো মেয়েটা দেখতে খুব রূপবতী ছিল। রূপবতী না হলে কি কোন ছেলে কোন মেয়ের প্রেমে পরে! মেয়েটাকে অন্য কারো কাছে ভালো লাগতে নাও পারে, তাকে আমার কাছে ভালো লেগেছে মানে সে আমার চোখে রূপবতী। সে মেয়েটার রূপের কথা বলে আমার বিশ্বাস হরণ করতে চেয়েছিল, সে ভেবেছিল আমি হয়তো মনে মনে ভাববো- আরে আসলেই তো মেয়েটা অনেক রূপবতী ছিল, তার পেছনে অনেক ছেলেরা ঘুরঘুর করতো!’
৪.
নিঃশব্দ গভীর রাত, যেন রহস্যময়তার এক আচ্ছাদন। চাঁদের ম্লান আলোয় ডুবে আছে পথের প্রান্তর, আর তারারাজি যেন দূর আকাশে নীরবে গান গাইছে। আজ তেমন কুয়াশা নেই। জানালা দিয়ে চাঁদের আলোয় দেখা যায় দূরের ঐ কাশবনের পাশে কদবানের মার ছোট্ট ঘরের নিভুনিভু আলো। বাতাসে হালকা শীতল পরশ, বৃক্ষের ছায়া পরেছে নিস্তব্ধ মাটির বুকে। এই নিস্তব্ধতা ভেঙে, দূর কোথাও কোন পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ—একাকি, নির্জনতার মধ্যে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের আহ্বান। রাত যেন এক গভীর সাগর, যার তলদেশে চাপা পড়ে আছে অসীম অনুভূতির ঢেউ, শান্ত অথচ রহস্যময়। আমি বিছানায় চেয়ে দেখি নীলিমা এখানে নেই৷
শীতের সকালে গায়ে চাদর প্যাঁচিয়ে জুবাইদা নূর আমাদের বাড়ির গেইটে এসে দাঁড়িয়ে আছে৷ দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না৷ সে বাবার কাছে এসেছে৷ বাবার এখনো ঘুম ভাঙেনি। আমি জানালা দিয়ে তাকে দেখে জলদি করে নিচে মেনে আমার ঘরে বসতে দেই। চা খেতে খেতে তার মামলা-মোকদ্দমার কথাগুলো শোনতে থাকি। কথা বলতে বলতে এক সময় জুবাইদা নূর কেঁদে ফেলে। বাবার ঘুম ভাঙতে আরো ঘণ্টাখানেক লাগবে। আমি যেয়ে বাবাকে ওঠালাম বললাম, বাবা জুবাইদা নূর এসেছে। তার কথা বলতেই বাবা তড়িঘড়ি করে ওঠে বসে।
কাচারি ঘরটা ভেঙে সেখানে বড়ো চাচা একটা লাইব্রেরি করবে ভেবে রেখেছিল অনেক আগেই। আজ সেটার কাজ ধরেছে৷ মাটি খুঁড়তেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে জসিম চাচার হাড়গোড়। যিনি বেঁচে থাকলে আমার বড়ো চাচা হতেন৷ শ্রমিকরা সেগুলোকে নির্ভয়ে ওঠিয়ে রাখে তারপর গোরস্থানে নিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। আমি আর নীলিমা জসিম চাচাকে দেখিনি কিন্তু তার হাড়গোড় দেখেছি। সেগুলো দেখে আমাদের কোনো মায়া হয়নি। জসিম চাচার প্রতি আমাদের কোন আবেগ জন্ম হয়নি। কারণ, আমাদের আবেগ মায়া প্রেম তাদের প্রতি জন্মায়, যাদের সাথে আমাদের সোনালি মূহুর্ত কেটে যায় কিংবা কাটে। আমাদের মায়াগুলো যতটানা থাকে মানুষের প্রতি তার থেকে বেশি থাকে সেই বিশেষ মুহুর্ত গুলোর প্রতি। জসিম চাচার সাথে আমাদের কোন মূহুর্তের স্মৃতি নেই, তাই তার প্রতি আমাদের হৃদয়ে কোন টান নেই। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই লাইব্রেরির কাজ শেষ হয়। গাড়িতে করে আসতে থাকে অনেক অনেক বই, অনেক অনেক কাব্য-মহাকাব্য।
নীলিমার সাথে চিন্ময়ের প্রেম খুব গভীর হয়ে ওঠেছে। ধিরে ধিরে বর্ণহীন প্রেম নীলবর্ণ হতে শুরু করেছে৷ সেদিন চিন্ময়কে বাবা একটা বিশেষ কাজে খুলনা পাঠিয়েছে৷ আমি চুপিচুপি তার ঘরে যেয়ে দেখলাম টেবিলের উপর অনেকগুলো ফাইলের সাথে একটা ডায়েরি রাখা আছে। আমি ডায়েরিটা খুলে দেখলাম সেখানে নীলিমার অনেকগুলো ছবি সে খুব যন্ত করে রেখেছে। প্রতিটা ছবির সাথে লিখে রেখেছে তার সুক্ষ্ম অনুভূতি। আজ বাবা বড়ো চাচা কেউই বাড়িতে নেই। নীলিমা খুব সেজেগুজে বাহিরে বেরিয়েছে। তার পরনে সাদা আর নীল রঙের ডোরাকাটা শাড়ি, চিন্ময়ের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। শীতল বাতাসে গোধূলিবেলায় হাতে হাত রেখে তারা হাটতে হাটতে কাটিয়ে দেবে অনেকটা পথ; অন্ধকারে তাদের আলোকিত করবে প্রেমের আলো, আনন্দের হাসি, স্নেহের ছোঁয়া। তারপর তাদের ঘিরে জন্ম হবে অগন্য প্রতিশ্রুতি।
বাবা আর বড়ো চাচা আজ বাড়ি ফিরবে না। তারা মেঝো ফুফুর বাড়িতে গেছে৷ আসতে আসতে কাল দুপুর হবে। বাহিরে আজ প্রচন্ড কুয়াশা পরেছে। রাত গভীর হলে নীলিমা চলে যায় তার পরিচিত গন্তব্যে। অন্য সময় ছাদে তার একাকিত্বের জংশনে বন্ধু হয়- রাতের আকাশ, চাঁদ, নক্ষত্র….. আজ তার সঙ্গ দিবে চিন্ময়। সেখানে তারা ঘন কুয়াশায় একাকার হয়ে দুজন দুজনকে সাপটে ধরে রাখবে, একে অন্যের চোখ পানে থেকে পাঠ করবে প্রেম কাব্য-
তোমার পানে চেয়ে থেকে নিশির সেতু দিবো পারাপার –
গোটা বিশ্ব অস্বীকার করুক, আমিই জানি তুমি আমার।
হয়তো প্রশ্ন হবে, ‘আমি কিভাবে তোমার?’
‘উপন্যাস পড়ও?’
‘না।’
‘একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম। সেখানে একটা বাড়ি থাকে। বাড়ির চারপাশ ঘিরে থাকে বিশাল দেওয়াল। যে দেওয়ালের কারণে দেওয়ালের ওপাশে কি আছে সেটা দেখা যায় না। লেখকের মনে গভীর আকাঙ্খা সে দেওয়ালের ওপাশে কি আছে সেটা দেখার জন্য। একদিন সে কোনো একটা কারণে পাশের একটা পাহাড়ের ওপড়ে ওঠে। সেখান থেকে সে তাকিয়ে দেখলো সেই দেওয়ালটার ওপাশে খুব সুন্দর একটা বাড়ি। লেখক মনে মনে ভাবলো, ওফ! এই বাড়িটা যদি আমার হতো! পরক্ষণেই তার মাথায় এলো, এ বাড়িতো তারই! এই যে সে বিশাল বাড়ির সৌন্দর্য দেখে পুলকিত হলো, এ বাড়ির সৌন্দর্য তার মনে দুদন্ড প্রশান্তি এনে দিল; তার মানে এই বাড়ির সৌন্দর্য উপভোগের অংশ সেও হলো। সেক্ষেত্রে সেই বাড়িটা তো তার বলাই যায়। লেখকের সে মহৎ চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে আমার যা ভালো লাগে, যা আমার মনে প্রশান্তি এনে দেয় সে সব কিছুই আমার। এই নিস্তব্ধ রাত, শীতল বাতাস,জোছনা, ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ানো প্রকৃতি, পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, প্রহরে মুরগের ডাক সব কিছুই আমার। তুমি আমার।’ বলতে বলতে তারা দুজন দুজনকে আরো শক্ত করে সাপটে ধরবে। তাদের ঘিরে আবার জন্ম হবে অগন্য প্রতিশ্রুতি।
বাবা বাড়িতে এলে চিন্ময় বাবাকে বলে,’স্যার আপনি যাওয়ার পর গতকাল বিকেলে মহিলাটা আবার এসেছিল।’
‘কোন মহিলা।’
‘ঐ যে স্যার ভদ্র মহিলাটা মামলার ব্যাপারে সকালে এসেছিল, জুবাইদা নূর।’
‘কিছু বলেছে?’
‘জিনা স্যার, এসে আপনার কথা জিজ্ঞেস করে আবার চলে গেছে। বলেছে আগামীকাল আসবে।’
‘তুমি বলনি আগামীকাল বৃহস্পতিবার।’
‘জি স্যার বলেছি, বলল যে তাও আসবে। এসে অল্পকিছু কথা বলে আবার চলে যাবে। স্যার মহিলাটার নীলিমার মতো একটা রোগ আছে!’
‘কি রোগ!’
‘প্রয়োজন অপ্রয়োজনে শুধু কান্নাকাটি করে৷ এসে আপনি বাড়িতে আছেন কিনা সেটাও সে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলো৷’
‘তার হৃদয়ের গভীরে বয়ে বেড়াচ্ছে দুঃখের অথই স্রোত। আচমকা তার জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার ; তার প্রতিটি অশ্রু অজানা বেদনার এক একটি কণা, যা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না তা প্রকাশ পায় তার অশ্রুতে। নিজের দুর্বলতাকে সে শক্তি বলে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু ব্যথা যখন অসীম বোঝা হয়ে ওঠে, তখন সে হারিয়ে ফেলে শক্তির অবশেষটুকু। মানুষ কাঁদে কারণ, তার হৃদয়ও সৃষ্টির মায়ায় বাঁধা।’
ঘন কুয়াশ ভেদ করে ভোরের নীরব আলোয় ভেসে আসে এক নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি। পূর্বাকাশের প্রথম আলোয় ফোটে যেন জগত শ্রেষ্ঠ ফুল, প্রকৃতির স্নিগ্ধ চুম্বন। হাজারো গাছের পাতা নুয়ে পড়ে যেন স্নিগ্ধতার ঢেউয়ে। শিশির ভেজা ঘাসকে যখন ভোরের সূর্য আলতো করে ছোঁয়, মনে হয় পৃথিবীর প্রতিটি শৈল্পিক স্পর্শ ভোরের বুকেই লুকান্তর। শীতল বাসাতে পাখির গুঞ্জন, পাতার মর্মর আওয়াজ সব মিলে নীরবতার মধ্যে এক রহস্যময় সুরের সৃষ্টি করে, যাকে শুধু অনুভব করা যায়। ভোরের কোমল আলোয় চোখ মেলে দেখি, জীবনের সমস্ত ক্লান্তিকে পাশ কাটিয়ে পৃথিবী আরও একবার সুন্দর হয়ে ওঠেছে।
সপ্তাহের অন্যান্য দিনে বাবা বেলা করে ওঠলেও আজ সে ভোরের পাখির সাথেই জেগে ওঠেছে। আজ বৃহস্পতিবার, মায়ের মৃত্যু দিন। তার ভোরের সাথি হয় মোড়কের ডাক, পাখির কিচিরমিচির, ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস, ঘন কুয়াশা। সে এখন প্রতি বৃহস্পতিবারের মতোই দরজা বন্ধ করে কালো পাঞ্জাবি গায়ে তার ঘরে বসে থাকবে, সারাদিন আর ঘর থেকে বের হবে না; হয়তো বড়ো চাচা দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করবে, আমি আর নীলিমা গিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দেবো। কিন্তু আমার ধারণাকে পদাঘাতে পিষে বাবা তার ঘরের দরজা খোলে কালো পাঞ্জাবি গায়ে বাহিরে বের হয়। পুরো রাস্তা ফাঁকা কেবল মাঝে মাঝে দু-একটা রিকশা চলাচল করছে। বাবা কোথায় যাচ্ছে জানিনা। আমি তাকে পেছন থেকে দেখছিলাম, সে ক্লান্ত প্রাণে সোজা সামনের দিকে হেটে যাচ্ছে৷
ঘড়ির কাটা যখন দশের ঘরে বাবা তখন তার নিজ ঘরে ফিরে আসে নিঃশব্দ পায়। কিছুক্ষণ পর বড়ো চাচা এসে বাবাকে বলল-
‘তুই যাওয়ার পর ঐ মহিলাটা আবার এসেছিল। কি যেন নাম! জুবাইদা নূর। এনিয়ে সে বাড়িতে অনেক বার এসেছে। আমার গণনায় উনিশ বার। আমি সব সময় বাড়িতে থাকি না, তার মানে সে আরো অনেক বার এসেছে; মোটামুটি ত্রিশ-চল্লিশ বার হবে৷ এতোবার তাকে আসতে হচ্ছে। তার বিষয়টার কি সমাধান করতে পারিস না!’
‘তার বিষয়টার সমাধান করে দিলে সে তো আর আসবে না। তার সব কিছু অনেকটাই চন্দ্রিমার মতো।’
‘সে চন্দিমার মতো দেখতে এটা কি তার অপরাধ! এখানে তো তার করার কিছু নেই। তুর স্ত্রীর মতো তার চেহারা তাকে দেখে তুই তুর স্ত্রীকে দেখার শূন্যতা পূরণ করতে চাস কিন্তু সে যে মেয়ে মানুষ এতোবার বাড়িতে আসছে তার কষ্ট হচ্ছে না? সে তুর দারস্থ হয়েছে একটা বিপদে পরে, এর মধ্যে তুই যেটা করছিস সেটা স্বার্থপরতা।’
‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়ে নিজেকে স্বার্থপর প্রমাণ করতে পৃথিবীতে মানুষ অনেক কিছু করে; যদি পৃথিবী একবার বুঝতে পারে কেউ স্বার্থপর না তবে পৃথিবী তাকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করে। তার সাথে এমন এমন কিছু ঘটে যে সে একসময় না একসময় ঠিক স্বার্থপর হয়ে যায়।’
৫.
কালের স্রোতে মিশে গেল আরও একটি সপ্তাহ। নতুন রূপে নতুন সম্ভাবনায় ফের দেখা দিল আর একটি বৃহস্পতিবারের সূর্যোদয়। আজ জুবাইদা নূরের মামলার রায় হবে। আজ বাবার কোর্টে যাওয়ার কথা না হলেও তিনি আজ কোর্টে যাবেন।
কোর্টে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে জজের রায়ে বাবার মক্কেল বিজয়ী হয়। কোর্টে জুবাইদা নূর কান্নায় ভেঙে পরে। জুবাইদা নূর তার কোমল বুকের উষ্ণতায় মায়ের মতো করে তার নির্দোষ ছাত্রকে ভালোবাসায় আগলে রাখে; মায়ের আঁচলের মতো সুরক্ষা দিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়, সব ভয় আর বিপদ থেকে আড়াল করে- যেন নির্দয় বিশ্বাসঘাতক পৃথিবীর কোনো ছোঁয়া আর তার গায় না লাগে। সেদিন সন্ধ্যার শেষ আলোয় আবেশ মাখা আকাশে, নীরবতার ছায়া যখন নেমে আসে ধীরে ধীরে, তখন জুবাইদা নূর আমাদের বাড়িতে আসে। বাবা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ইজিচেয়ারে পুরানো ডায়েরি হাতে তখন বসে আছে। জুবাইদা নূর বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অপার শ্রদ্ধায় বললেন, ‘মীলন সাহেব আমি কি ভিতরে আসবো?’ বাবা তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আলতো করে দরজাটা খোলে দেয়। তারপর জুবাইদা নূর ঘরের ভেতর যেয়ে বসলো। জুবাইদা নূর তার শাড়ির ভেতর থেকে হাত বের করে বাবার দিকে একটা হলুদ রঙের চিঠির খাম বাড়িয়ে দেয়। বাবা সেটা দেখে মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল; যেন তার এ দীর্ঘশ্বাসের সাথেই বেরিয়ে গেল তার বহুবছরের লালিত অগণ্য আর্তনাদ। তারপর বাবা খামটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল-
‘আমার কাছে যারা আসে- আমি কোর্টে যাওয়ার আগে, তাদের থেকে আমার সম্পূর্ণ পেমেন্ট নিয়ে নেই। Only in your case it is completely the opposite, তার প্রথম কারণ- আমার কাছে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে অনেক মানুষ আসে কিন্তু তারা কেউ আসে নিজেদের বিষয়ে আবার কেউ আসে তাদের আত্মিয়স্বজনের বিষয়ে। But you are the only person, যে কিনা তার ছাত্রের জন্য আমার কাছে বারবার এসেছে। আমি আপনাকে প্রথমদিন বসেছিলাম, মামলার রায় হবার পর আমি আপনার থেকে টাকা নেবো, কিন্তু আমি আপনার থেকে টাকাটা নিতে পারছিনা; I’m very sorry for about this.’
এ বলে বাবা খামটা জুবাইদা নূরের দিকে বারিয়ে দেয়। জুবাইদা নূর সংকোচবোধ করতে করতে বাবার হাত থেকে খামটা নিল। তারপর সে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল- ‘আপনার বোধহয় আরো একটা কারণ বাকি আছে।’ তখন বাবা বলল-
‘দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, আপনি দেখতে অনেকটা আমার স্ত্রীর মতো। আমার স্ত্রী অনেক আগে মারা গেছে। অনেক দিন তাকে দেখিনা, আপনাকে দেখলে কিছুটা ভালো লাগে, তাই আপনার কাজটা আমি খুব ধীরে ধীরে করেছি; যাতে আপনি প্রয়োজনে বারবার আমার কাছে ছুটে আসেন। আর আমি যাতে বারবার আপনাকে দেখে আমার স্ত্রীকে দেখার যে শূন্যতা সেটা সামান্য পূর্ণ করতে পারি। এটা আমার স্বার্থপরতা হয়েছে কিন্তু নিজের একটু প্রশান্তির জন্য আমাকে বিবেকের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে হলো।’
‘আপনার মতো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আপনার টাকা-পয়সা ভালো আছে, সুনাম আছে, আপনি চাইলে আর একটা বিয়ে করতে পারতেন।কিন্তু আপনি তা করেননি। শুনেছি পৃথিবীতে নাকি একই রকম চেহারার সাতজন মানুষ থাকে। আপনার স্ত্রীর মতো দেখতে অন্য কাউকে যদি কখনো পেয়ে যান, তাহলে তার দিকে চেয়ে শূন্যতা কাটানোর চেষ্টা করবেন। আমার সাথে আর কখনো আপনার দেখা নাও হতে পারে। আপনাকে এতোদিন আমার প্রয়োজন ছিল তাই বারবার এসেছি৷ এখন আমার প্রয়োজন মিটে গেছে, এখন আর আসবো না; পৃথিবীতে সঙ্গ কেবলই প্রয়োজনের ঋণ।’
এ বলে জুবাইদা নূর চলে গেল, বাবা আবার তার ঘরের দরজা আটকে দেয়। আর বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পরে। সন্ধ্যার ছায়া যখন ঘনিয়ে আসে বাতাসে তখন মিশতে থাকে নিঃশব্দের ছোঁয়া। বাবা তখন কালো পাঞ্জাবি গায়ে চোখে নির্ভীক এক ভাষা নিয়ে আবার ঘর ছেড়ে যাত্রা করে গন্তব্যহীন পথে, কোন এক রহস্যের মোড়ে। নীলিমা বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছিল, বাবা চুপিচুপি পায় হাটতে হাটতে আবার হারিয়ে যান সন্ধ্যার ঢেউয়ে; আটকে পরে অন্ধকারে আর ঘন কুয়াশার চাদরে। বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যায় বাবার এ গন্তব্যহীন পথে চুপিচুপি পায় পথচলা যেন জীবনের ব্যস্ততার মাঝে এক শান্ত অবসর।
রাত বারোটা নাগাদ বাবা বাড়ি ফিরে আসে। আজ জোছনার আলোয় চারপাশ নবযৌবনের কিশোর-কিশোরীর মতো টগবগ করছে। গোটা আকাশ গায় জরিয়েছে তারকার অলংকার। প্রকৃতি যেন অমূল্য সুধা ঢেলে দিচ্ছে নিঃশব্দে। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্য আমি নির্জনে আনমনা হয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি বারান্দা থেকে। খানিকক্ষণের জন্য নীরবতায় আমি হারিয়ে যাই এক ভিন্ন জগতে। হঠাৎ সেখান থেকে এক ভয়ংকর বাস্তবতায় ফিরে আসি। চিন্ময়ের চিৎকার শুনতে পাই বাবার ঘর থেকে। দৌড়ে যেয়ে দেখি বাবাকে দারোয়ান, বড়ো চাচা আর চিন্ময় ধরাধরি করে নিচে নামাচ্ছে। তাকে ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নিতে হবে, বাবা বোধহয় স্ট্রোক করেছে।
আমরা সবাই হাসপাতালের করিডোরে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেন প্রতীক্ষার সমুদ্রের মাঝে ভাসমান কিছু নীরব নৌকা। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে শোকের সুর বাজে, অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাসে যেন বাতাসও ভারী হয়ে ওঠে। আমি আর নীলিমা কান্নায় ভেঙে পরি। বড়ো চাচা তখন নীলিমা আর আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন। বাবাকে কেবিনে নিতেই আমরা সবাই তার কাছে ছুটে যেতে চাই। কিন্তু ডাক্তারের করা নির্দেশ যেন একজনের বেশি রোগীর ধারেকাছে কেউ না যায়, আর কেউ যেন তার সামনে যেয়ে কান্নাকাটি না করে। আমি করুন ভাবে বড়ো চাচার মুখের দিকে তাকালাম। বড়ো চাচা আমাকে চোখের ইশারায় বললেন- তুই ভেতরে যা। আমি ভেতরে গিয়ে বাবার মাথার কাছে বসলাম। বাহিরে থেকে দরজার ওপাশে তারা সবাই দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখছে। বাবাকে অক্সিজেন লাগিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর আমি মাথার কাছ থেকে ওঠে গিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসলাম। বাবা গভীর ঘুমে আছে। আমার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। আমি খেয়াল করলাম, আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার পা দুটোকে আমার কপালে ঘষছি। তখন আমার মনে পরে সেই স্বপ্নের কথা; যেখানে একটা বলবান শিয়াল মোটা একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। শিয়ালটাকে দূর থেকে অনেক লোক দেখছে আর সে শিয়ালটার পায়ে একটা ব্যাং তার মাথা ঘষছে। স্বপ্নের শিয়ালের মতোই বাবা এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, দূর থেকে সবাই বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি স্বপ্নের সেই ব্যাঙের মতো করে বাবার পায়ে আমার মাথা ঘষছি। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পেরেছি সেই স্বপ্নের ইশারা। জুবাইদা নূরের সাথে বাবার আর কখনো দেখা না হওয়ার কথা থাকলেও, এই মাঝ রাতে জুবাইদা নূর আবার ছুটে এসেছে বাবাকে এক নজর দেখার জন্য। আমি ভেতর থেকে কাচের দরজা ভেদ করে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জুবাইদা নূরকে দেখতে পাই, দেখতে পাই বাবার জন্য তার গাল বেয়ে ঝরে পরা দুচোখের দুফুটা নীরব অশ্রু। তার অশ্রু এভারেস্ট সমান এক মিথ্যাকে নিমিষেই ধূলিসাৎ করে দিয়ে প্রমাণ করে পৃথিবীতে সঙ্গ কেবলই প্রয়োজনের ঋণ নয়; সঙ্গ হচ্ছে নিঃস্বার্থ হৃদয়ের নৈঃশব্দের টান।
ভোর পাঁচটা নাগাদ এক নীরব প্রহরে, ভোরের নিস্তব্ধতায় পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে, ঠিক তখনই আমরা অনুভব করি আকাশ সমান অদৃশ্য শূন্যতা। বাবার বিদায় ঘণ্টা বেজে গেলো আর নিঃশব্দে থেমে গেলো তার জীবনের গল্প; পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি পাড়ি জমালেন ভিন্ন এক দেশে। যেন ভোরের এই শীতল বাতাস তার শেষ নিশ্বাসের সাক্ষী।
বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ছোটো চাচা বাড়ি ফিরে আসে। বাবা আর বড়ো চাচার সাথে ছোটো চাচার কোনো একটা বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়, তারপর সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর আজ বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসে। ছোটো চাচা আমাদের দুবোনকে সান্ত্বনা দিতে যেয়ে সে নিজেই তার ভাষা হারিয়ে ফেলে আর মুখ চেপে আমাদেরকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আমরা ভেবেছিলাম ছোটো চাচা আর কখনো ফিরবেনা। কিন্তু সে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে আমাদের অদৃশ্য শূন্যতাকে পূর্ণ করতে। ছোটো চাচার উপস্থিতিতে খুব দ্রুতই আমরা বাবার শোক কাটিয়ে ওঠতে চেষ্টা করি কিন্তু বাবা হচ্ছে পরন্ত বিকেলের শূন্য আকাশে বনকপোত, বাবা হচ্ছে মহাসমুদ্র- যার স্রোত জীবিত করে মৃত্যু নদী, থেমে থাকা নদীকে দেখিয়ে দেয় প্রবাহের পথ; তাকে ভুলে যাওয়া দুঃসাধ্যের ব্যাপার।
বাবাকে গোরস্থানে শুইয়ে দিয়ে চিন্ময় আর আমাদের বাড়ি ফিরেনি। চিন্ময়ের ঘরে তার সব কিছুই রয়ে গেছে; নীলিমার সাদা আর নীল রঙের ডোরাকাটা শাড়ির সাথে মেলানো তার সাদা পাঞ্জাবি, টেবিলের উপরে ফাইলের সাথে তার ডায়েরি, চিন্ময়ের মায়ের হাতে বুনা নকশিকাঁথা…..। সে বোধহয় আর কখনো এ বাড়িতে ফিরবে না। দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, তার কোনো খোঁজখবর নেই। বাবা যেমন আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে সেও হয়তো নীলিমার থেকে বিদায় নিয়েছে। আমার থেকে নীলিমার কষ্টটাই এখন বেশি, আমি তো কেবল বাবাকে হারিয়েছি; সে বাবার সাথে সাথে তার হৃদয়ের স্টেশনও হারিয়েছে। মানুষের ক্লান্তিতে মানুষ সুখ খুঁজে পায় কোন একজন মানুষের কাছে। কিন্তু সেই মানুষটাই যখন স্রোতের সাথে ভেসে যায় তখন ক্লান্তি সীমাহীন হয়ে দাঁড়ায়। নীলিমা সামান্য বিষয়ে কাঁদলেও একদিকে বাবা হারানোর শোক আর অন্যদিকে চিন্ময়ের বিচ্ছেদ তাকে কাঁদাতে পারছেনা। কি অদ্ভুত ব্যাপার! তার চোখে কোনো অশ্রু নেই!
মানুষের জীবন অতিবাহিত হয় এক বিস্ময়কর নিয়মে; যেখানে নিয়মগুলো হয় অনিয়ম আর অনিয়মগুলো হয় নিয়ম। এই যেমন নীলিমার কথাই চিন্তা করি। ওর বয়স গতমাসে ষোলো হলো। কি ভয়ংকর একটা বয়স; ওকে এখন প্রেমের উন্মাদনা চেপে ধরবে চারপাশ থেকে কিন্তু তাকে এসময়ে পুড়তে হচ্ছে বিচ্ছেদের আগ্নেয়গিরিতে, তাকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে অজস্র আর্তনাদ।
কোনো কিছুতেই আমার ভালো লাগছেনা। হাটতে হাটতে বড়ো চাচার লাইব্রেরিতে গেলাম, সেখান থেকে ব্রিটিশ এক বিখ্যাত রাইটার আগাথা ক্রিস্টির ‘মিস মার্পেল’ বইটা হাত নিলাম। আমার সব কিছু কেমন অস্থির অস্থির লাগছে, আমি বই পড়তে পারছি না। একবিন্দু শান্তির খুঁজে আমি দিশেহারা হয়ে গেছি কিন্তু আমার সে শান্তি যেন লুকিয়ে আছে অজানা কোনো কিছুতে যা আমি স্থির করতে পারছিনা। অবশেষে আমি লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসি। কি মারাত্মক ব্যাপার! যে বই মানুষ গড়ে, সে বই মানুষকে শান্ত রাখতে পারে না। আমি লাইব্রেরির চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়াতেই হৃদয়ের গম্ভীরতার বহিঃপ্রকাশ হয় এক নীরব দীর্ঘশ্বাসে।
বড়ো চাচা আর ছোটো লাইব্রেরিতে বসে আলাপ করছে। নীলিমা ছাদের এক কর্ণারে নীরব হয়ে বসে আছে। আজ আমাদের বাড়িতে জুবাইদা নূর আবার এসেছে। দিনকে দিন তাকে আমাদের খুব আপন মনে হচ্ছে। সেও হয়তো বারবার এসে আপন করে নিয়েছে আমাদেরকে, আমাদের বাড়ির কুকুরটাকেও। কুকুরটা বাড়িতে নতুন কাউকে দেখলে ঘাও ঘাও করে চ্যাঁচাতে থাকে কিন্তু জুবাইদা নূরকে দেখে সে চ্যাঁচায় না। শোনেছি কুকুর নাকি আগ থেকে অনেক কিছু আঁচ করতে পারে। কুকুরটা কি আঁচ করে রেখেছে জুবাইদা নূর খুব দ্রুতই আমাদের বাড়ির লোক হয়ে যাবে! বড়ো চাচা যখন কলেজে পড়ে তখন ক্লাস টেনের এক কিশোরীর প্রেমে পরে সে। তাদের মাঝে প্রেম হয়েছে, অনেক অনেক প্রতিশ্রুতি হয়েছে। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা তত ভালো ছিলনা। বড়ো চাচাও তখন বেকার, কোনো চাকরি-বাকরি নেই। তারপর অনেক ঘটনা। পরিশেষে মেয়েটার ভালো সম্বন্ধ আসে আর সে সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে নেয়। তারপর বড়ো চাচা ঠিক করলেন তিনি আর বিয়ে করবেন না; এবং সে এখন পর্যন্ত বিয়ে করেননি। তবে কি তিনি শেষ বয়সে এসে সেই কিশোরীকে ভুলে তার সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে জুবাইদা নূরকে বিয়ে করবে! জুবাইদা নূরের সাথে ছোটো চাচাকে পরিচয় করিয়ে দেয় বড়ো চাচা। জুবাইদা নূর বড়ো চাচাকে আমাদের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- সমুদ্র ভ্রমণের কথা।
বড়ো চাচা আর ছোটো চাচা মিলে ঠিক করেছে তারা আমাদের নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাবে। সমুদ্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার বিস্তৃতি। যেখানে ঢেউয়ে ঢেউয়ে মুছে যায় হৃদয়ের কালো দাগ, কল্লোল হরণ করে হৃদয়ের আর্তনাদ। আমরা সমুদ্রের উদ্দেশ্যে আগামীকাল রাতে রওনা হবো।
পরদিন সারারাত গাড়িতে কাটিয়ে ভোরের আলো চোখে পরতেই আমরা গাড়ি থেকে নামি। আমাদের চোখ কেরে নেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার বিস্তৃতি মহাসমুদ্র। দূর পানে চোখ যেতেই যেন বিশাল আকাশ বিশাল সমুদ্র একাকার। খনিকের জন্য যেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে মুছে যায় হৃদয়ের কালো দাগ, কল্লোল হরণ করে হৃদয়ের আর্তনাদ। বড়ো চাচার লাইব্রেরিতে বিখ্যাত লেখকের বিখ্যাত বই থেকে চেয়ে আমি যে প্রশান্তি পাইনি প্রকৃতি আমাকে না চাইতেও তার দ্বিগুণ প্রশান্তি এনে দিয়েছে। এই প্রকৃতিই যেন মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। বড়োচাচা আর ছোটো চাচা আমাদের দুজনকে দুপাশ থেকে হাত ধরে রেখেছে। আমরা হাত বেঁধে মহাসমুদ্রের অভিমুখে হাটছি। আমাদের পায়ের তলায় লবণাক্ত পানির স্পর্শ পেতেই নীলিমা আমায় জিজ্ঞেস করে, হিমা আজ কি বার? উত্তরে বললাম, বৃহস্পতিবার।
ছোটো চাচা বলল, ‘কিসের আওয়াজ?’
জবাবে বড়ো চাচা বলল, ‘কল্লোল। কলকল শব্দ হরণ করে নিচ্ছে হৃদয়ের অজস্র আর্তনাদ।’