ধর্মপাতা: অর্থনীতি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামি শরিয়ত এ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ও ন্যায়নিষ্ঠ অর্থব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ইসলামি শরিয়ত একদিকে ধন-সম্পদকে জীবনের লক্ষ্যজ্ঞান করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং সম্মান, ইজ্জত ও কোনো পদমর্যাদা লাভকে এর ওপর নির্ভরশীল করা হয়নি। অন্যদিকে সম্পদ বণ্টনের নিষ্কলুষ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে, যাতে কোনো মানুষ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত না থাকে এবং কেউ সব সম্পদ এককভাবে কুক্ষিগত করে না বসে। এ ছাড়া সম্মিলিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি যৌথ ও সাধারণ ওয়াকফের আওতায় রেখেছে। ইসলামে ব্যক্তিমালিকানার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। ইসলাম হালাল দ্রব্যের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছে এবং তা রাখার ও ব্যবহার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।
দান-খয়রাত বা খরচের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো কোনো মানুষ আছে, যারা দান-সদকা ও ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মুক্তহস্ত। এমনকি কোনো কোনো সময় তারা ঋণ করেও খরচ করে। নিজের সামর্থ্যরে প্রতি তাদের লক্ষ্য থাকে না। এসব কাজ থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হইয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হইয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত হয়ে বসে থাকবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৯)
মুমিনের কাজ হবে কৃপণতা না করা এবং নিজের ও নিজ পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতি যথাযথ খেয়াল রাখা। প্রতিবেশী, দুস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্তদের দান না করে কৃপণতাবশে সম্পদ কুক্ষিগত করা যেমন অপরাধ, তেমনি নিজের ও পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য না রেখে সর্বস্ব দান করাও ঠিক নয়; বরং মুমিনের কাজ হবে এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৮)
অর্থাৎ নিষিদ্ধ অপচয়-অপব্যয় ও নিন্দিত ব্যয়কুণ্ঠতা-কৃপণতার মধ্যবর্তী মিতাচার-মিতব্যয়িতা এবং অর্থসম্পদ খরচের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। এটাই হচ্ছে অর্থসম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোরআনি বিধান। যে ব্যক্তি তা অবলম্বন করবে সে সৌভাগ্যবান হবে, মুক্তি পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে দুর্ভাগা হবে এবং ধ্বংসে নিপতিত হবে। অবশেষে সে আফসোস করবে।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বিভিন্ন অভিমত দিয়েছেন। যেমন-
১. আন-নুহাস (রহ.) বলেন, আল্লাহর আনুগত্যের পরিপন্থী কাজে খরচ করা হচ্ছে অপচয়, আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় না করা হচ্ছে কৃপণতা আর তাঁর আনুগত্যে খরচ করাই হচ্ছে মধ্যপন্থা।
২. ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লাখো দিরহাম সত্য-সঠিক কাজে ব্যয় করে সেটা অপব্যয় নয়। পক্ষান্তরে যে এক দিরহাম অন্যায় পথে ব্যয় করে সেটা হচ্ছে অপচয়। আর যে সৎ ও সঠিক পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে সে কৃপণতা করে।’ মুজাহিদ ও ইবনু জায়েদ (রহ.)ও অনুরূপ বলেছেন।
৩. ইবনু আতিয়া (রহ.) বলেন, কম হোক বেশি হোক-পাপের কাজে খরচ করা থেকে ইসলাম সতর্ক করেছে। অনুরূপভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা থেকেও সাবধান করেছে। এসব দোষ-ত্রুটি অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আয়াতে ব্যয়ের ব্যাপারে যে আদব বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে ইসলামসম্মত তথা বৈধ কাজে এমন পরিমিত খরচ করা, যাতে পরিবার-পরিজন ও অন্যের হক বিনষ্ট না হয়। কিংবা এমন কৃপণতা বা ব্যয় সংকোচন না করা, যাতে পরিবার-পরিজন ক্ষুধার্ত থাকে। অর্থাৎ অতিরঞ্জিত ব্যয়কুণ্ঠতা অবলম্বন করা। এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা হচ্ছে উত্তম ও ন্যায়ানুগ ব্যবস্থা তথা মধ্যপন্থা।
৪. ওমর (রা.) স্বীয় পুত্র আসেমকে বলেন, ‘হে বৎস, তুমি অর্ধপেট খাও এবং কাপড় না ছেঁড়া পর্যন্ত তা ছুড়ে ফেলে দিয়ো না। তুমি ওই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হইয়ো না, যারা আল্লাহপ্রদত্ত সবই তাদের পেট ও পিঠে রাখে। অর্থাৎ খায় ও পরিধান করে।’ (কুরতুবি ২০/৩৬৫; ফাতহুল কাদির ৫/৩৮৫)
অতএব, খরচের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা মুমিনের জন্য কর্তব্য। কেননা আল্লাহ মানুষকে খেতে ও পান করতে বলেছেন; কিন্তু অপচয় করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা খাও ও পান করো, অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
তিনি আরো বলেন, ‘অপব্যয় কোরো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা : বনু ইসরাঈল, আয়াত : ২৬-২৭)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা খাও, দান করো, পরিধান করো-অপব্যয় ও অহংকার ছাড়া।’ (নাসাঈ, হাদিস : ২৫১২; ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৩৫৯৫)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে অপব্যয় করা হচ্ছে সম্পদ ধ্বংসের কারণ এবং অর্থ-সম্পদ ধ্বংসের ফলে আল্লাহর অসন্তোষে নিপতিত হতে হয়। তেমনি পার্থিব জীবনে বিলাসিতাও গ্রহণযোগ্য নয়; বরং সহজ-সরল জীবনযাপনই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
আল্লাহ আমাদের মধ্যপন্থার জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন।