বয়:সন্ধিকালের মাঝামাঝি সময় তখন। কতই আর বয়স হবে তের কিংবা চৌদ্দ। পেন্সিলে আঁকা সরু রেখার মতো গোঁফের আভা দেখা দিয়েছে মাত্র। কৈশোর উত্তীর্ণ হয়নি স্বাধীনের। পড়াশোনার জন্য নিজ বাড়ির চেয়ে মামাবাড়ি উপযুক্ত মনে হওয়াতে সেখানে থেকে পড়াশোনা করে সে। স্বাধীন তখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। চোখে হাজার রঙের স্বপ্ন। বাঁধনহারা কৈশোর। এ সময়ে স্বপ্নেরা বাঁধনহারা হয়। স্বাধীনেরও তাই। স্কুল পড়াশোনা আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। এসব মিলে ভালোই চলছিল তার দিনকাল। হঠাৎ তার জীবনে আসে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা। প্রেমে পড়ে যায় স্বাধীন। প্রেম ঠিক নয় এক তরফা প্রেম। রোমার প্রেমে পড়ে সে। কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলতে পারে না তাকে। মনের মধ্যে গুমরে মরে সে প্রেম। বের হতে পারেনা। এমন অবস্থায় প্রতিটি দিন তার কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে। রোমা স্বাধীনের দূ:সম্পর্কের আত্মীয়া। রোমা আর স্বাধীনের চমৎকার সম্পর্ক। স্বাধীনের মনে খুব ভয় হয়, যদি রোমা ওকে নাকোচ করে দেয়? যদি সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়? অনেক অনেক চিঠি লেখে সে। আবার সেগুলো ছিঁড়েও ফেলে। সাহসের অভাবে সে দিতে পারে না। এটা নিয়ে অনেকের কাছে ধরাও পড়ে সে। তবুও রোমা বিষয়টা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারে না। স্বাধীনের ধারণা রোমা বিষয়টা বোঝে। কিন্তু রোমা আদৌ বিষয়টা কখনো সেভাবে দেখেনা। কথায় আছে মেয়েরা যত দ্রুত ছেলেদের মন পড়তে পারে। ছেলেরা তা পারে না। হয়তো এটি রোমার কম বয়সের কারণ। রোমাকে প্রচন্ড ভালোলাগতো স্বাধীনের। অনেক ভালোবাসে সে তাকে। সে এক স্বর্গীয় অবুঝ প্রেম। যেখানে ছিল না কোন উদ্দেশ্য মূলক চাওয়া পাওয়া। ওরা তখনো আসল বা প্রকৃত ভালোবাসার মানেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ছুটির একদিন স্বাধীন ওর রুমের দুইতলার রুমে বসে গান শুনছিল। কিছুক্ষণ পর সে দেখলো রোমা বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে পুকুরে যাচ্ছে ধোয়ার জন্য। স্বাধীন দ্রুত ঘর থেকে নেমে পুকুর ঘাটে গেল। কিছুক্ষণ সেখানে এলোমেলো পায়চারি করলো। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেল না। রোমা ওর এমন ভাব দেখে সেই আগে বললো, -কি হয়েছে তোমার কিছু বলবে? – না মানে, হ্যাঁ বলবো।
বলেই একটা চিঠি ওর হাতে গুজে দিয়েই ভয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালাল। চিঠিখানা পড়ে রোমাও খুব ভয় পেয়ে গেল। সেটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে পানিতে ভাসিয়ে দিল। তারপর জামা কাপড়গুলো না ধুয়েই হনহন করে সে বাড়ি চলে গেল। নষ্ট হয়ে গেল একটা মধুর সম্পর্ক। এখন রোমা আর স্বাধীনের সঙ্গে কথা বলে না। দেখলে পালিয়ে যায়। দূর দিয়ে হাঁটে। বাড়ি থেকে খুব একটা বের হয়না। এভাবে কিছু দিন কেটে যায়। স্বাধীন মাধ্যমিক পাস করে শহরের কলেজে ভর্তি হয়। রোমা স্বাধীনের বিষয়টা বুঝতে পারে। কিন্তু ততোদিনে অনেকটা ম্যাচিউর হয়েছে স্বাধীন। নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। এখনকার দিনের মতো মোবাইল ফোন ছিল না তখন। পাড়াতো এক ছোট ভাইয়ের কাছে প্রতি সপ্তাহে সে চিঠি লিখে রোমার খোঁজ খবর নিতো।
মাঝে মধ্যে রোমার সঙ্গে দেখা করতে যেত সে। এভাবে কিছুদিন কেটে যায়। রোমার বাবা একদিন খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। তারপর স্বাধীন একদিন রোমার বিয়ের খবর পায়। রোমা তাকে কিছু বলেনি। স্বেচ্ছায় বিয়েতে রাজী হয়। স্বাধীনের খুব রাগ হয়। সে আর কিছু বলে না। রোমার বিয়ের দিনটিতে হোস্টেলে ছিল স্বাধীন। অনেক পাগলামো করেছিল সে। মনে হচ্ছিল অনেক মূল্যবান কিছু তার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের আবর্তে এক সময় সব কিছু কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। স্বাধীনও বিয়ে শাদী করেছে। রোমা মেয়েটা বেশ বড় হয়েছে। মাধ্যমিক দেবে এবার। সাম্প্রতিক একটা অনুষ্ঠানে অনাকাঙ্খিত দেখা হয়েছিল রোমা আর স্বাধীনের। কত পরিণত আজ রোমা। লাইট কালারের শাড়ী আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কথা বলতে সংকোচ হয় স্বাধীনের। এগিয়ে আসে রোমা। বলে,
– কেমন আছো তুমি?
মুচকি হেসে স্বাধীন বলে,
– ভালো। তুমি তো অনেক বয়স্ক হয়ে গেছো?
তখন সেও একটা মুচকি হাসি হাসে।