রাস্তার ধারের ফকিরটা মরে পড়ে আছে নিজের চটের উপরেই। গত ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে মগবাজার এলাকার লোকেরা তাকে এই একটা জায়গায় বসেই ভিক্ষা করতে দেখেছে। শীত গ্রীস্ম বর্ষা সব সময় তাকে এখানে দেখা যেত। সে কারো কাছেই ভিক্ষা চাইতো না। কেবল সুর করে একটু পর পর বলত “আল্লাহ” ভোর বেলা থেকে মাঝ রাত যতক্ষন সে বসে থাকত কেবল অই একটা কথাই তার মুখ থেকে লোকে শুনতে পেয়েছ। আর কোন কথাই সে বলত না। সামনের থালি থাকত। যার যা মনে চায় তাই দিত। কেউ তার নাম জানেনা।গত তিন দশক ধরে সে একই রকম ই দেখতে ছিল।হরতাল কার্ফু প্রবল ঝড় বৃস্টি কোন সময়েই তাকে অনুপস্থিত দেখা যায় নি।এমন কি সাম্প্রতিক করোনা মহামারির সময়েও সে দিব্যি বসে বসে ভিক্ষা করেছে। বছর খানেক ধরে তার একটা কুকুর জুটেছিল। রাস্তার ঘেয়ো কুকুর।কুকুর টা তার সাথে সাথেই থাকত। কোথাও যেত না। আজো যথারীতি সে ভোর বেলায় বসেছিল ভিক্ষা করতে। ভিখারিটা যে মরে গেছে সেটা প্রথম আবিস্কার করে তার উল্টোপাশের ফুটপাতে বসা চা ওয়ালা রমজান আলি। সে ও এই জায়গায় চা বিক্রি করছে প্রায় দুই দশক।মাঝে মাঝে অই ভিখারি থেকে খুচরা ভাংতি নিয়ে আসত বড় নোট দিয়ে। রমজান চা বিক্রি করতে করতে শুনতে পেল রাস্তার অপারে কুকুরটা যেন এক টানা কেদে যাচ্ছে। লক্ষ্য করল ভিখারি টা তার চটের উপরে সটান শুয়ে আছে। কুকুর টা তাকে ঠেলছে আর এরকম শব্দ করছে। কউতুহল বশত রাস্তা পেরিয়ে দেখতে এল। ভিখারি টা শুয়ে আছে চার হাত পা ছড়িয়ে। মুখ খানিক টা খোলা। অর্ধনিমিলীত চোখ। কোন সাড়া শব্দ নেই। বুকের উঠানামা নেই। সে ডেকে আনল পাশের ডিস্প্যান্সারির প্যারামেডিক কে। সে তার ফার্মেসি তে অসুধ বিক্রি করে।পাব্লিকের প্রেশার ডায়বেটিস মেপে দেয়।স্যালাইন ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়। সবার কাছে মফিজ ডাক্তার নামে পরিচিত। প্রথমে একটু বিরক্ত হয়েছিল। তার পরেও রমজানের পিড়াপিড়ি তে এলো। কারন রমজানের পুরা পরিবার তার রুগী। মফিজ ডাক্তার বুকে স্টেথো লাগিয়ে তারপর তার নাড়ি দেখে বলল ” নাহ জান নাইগা। এক কাম কর আঞ্জুমানেরে খবর দেও। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কবর দিয়া দিবনে”। অহন একটা কিছু দিয়া লাশ টা ঢাইকা রাখো” এদিকে সেই কুকুর টা কেদেই চলেছে একটানা। যথারীতি আঞ্জুমানের গাড়ি এলো।ফকিরটার মৃত দেহ চ্যাং দোলা করে গাড়িতে তোলা হল।তার চট টা পাশের ময়লার গাদায় ছূড়ে দিতেই এক গাদা নোট কয়েন ছড়িয়ে পড়ল চার দিকে। এক টাকা দু টাকা থেকে এক হাজার টাকার অনেক নোট। অমনি চার পাশ থেকে অগনিত লোক মাছির মত হামলে পড়ল ময়লার গাদায় মরা ভিক্ষুকের টাকা কুড়াতে। এই কাড়া কাড়ি তে বাদ গেল না তার লাশ নিতে আসা কর্মীরাও। সবাই ব্যস্ত টাকা টোকাতে। সেই কুকুরটা এর মধ্যেই গাড়িতে উঠে সেই ভিখারির লাশের পাশে কেদেই চলেছে বিরামহীন।