এক. শান্ত বিকেল; কোন কোলাহল নেই। আকাশ মেঘমুক্ত। তেজহীন রৌদ্র। সূর্যের আলো ধীরে– ধীরে কোমল হয়ে আসছে। ছোট নদীর এক কোণের স্বচ্ছ জল কোমল আলো মেখে অদ্ভুত রূপ নিয়েছে। মায়মুনা বসে আছে তাদের বাড়ির একদম পাশের ছোট নদীর কিনারে। ডিঙি নৌকা তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর যে একটা ঢেউ এসে প্রান্তে মিলিয়ে যায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে অপলক নয়নে তা দেখে যাচ্ছে সে, সেই কখন থেকে। কেনো সে এটা দেখছে, কেনো এখানে বসে আছে, তা তার নিজেরও জানা নেই। আজ তার ভীষণ মন খারাপ। আবার মাঝে–মধ্যে অজানা এক পুলকের জোয়ারও এসে ধরা দিচ্ছে তার হৃদ কিনারায়। আগামীকাল মায়মুনার বিয়ে। তাদের বাড়ি আজ কলরবময়। বিয়ের নানান আয়োজন নিয়ে সবাই মশগুল। কেউ মায়মুনার শশুর বাড়ির লোকদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা নিয়ে, আবার কেউ মায়মুনাকে নিয়ে। তার স্বজনদের দিল–মনের অবস্থাও আজ তার মতোই । কখনো তাদের হৃদয় হাসছে আনন্দের আকাশে উড়তে উড়তে ; আবার কখনো তাকে অপরিচিত কারো হাতে তুলে দিচ্ছে তারা— এ-কথা ভেবে তাদের হৃদাকাশও কাঁদছে !
দুই. আজ মায়মুনার বিয়ে। পুরোটা বাড়িতে আনন্দের চেঁচামেচি। কোলাহল। ঘর–দ্বার সাজানো। বর পক্ষের আপ্যায়ন পর্ব শেষ। এখন মায়মুনাকে বিদায় জানানোর বিষাদ–ঢাকা ক্ষণ । তাকে বিদায় জানালো সবাই । কেউ হেসে–হেসে । আবার কেউ কেঁদে–কেঁদে । কতো শত স্মৃতির স্মরণে। আগের মতো নিত্য তাকে কাছে না পাওয়ার বেদনায়।
তিন. বহুক্ষণ ধরেই থেমে–থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে–মধ্যে দিল কাঁপানো বজ্রপাতও হচ্ছে। সাথে প্রচন্ড বাতাস। বর পক্ষের নৌকা স্টার্ট করেছে অল্পক্ষণ পূর্বে। মায়মুনা কাঁদতে–কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে কিছু সময় পর–পর। স্বজনদের ছেড়ে যাওয়ার বেদনায়। চিরচেনা নদী, মেঠোপথ আর গ্রাম্য সবুজ গাছগাছালির সাথে আর দু:খ ভাগাভাগি করতে না পারার বেদনায়। অনেকে আবার নৌকায় বসে গল্পের আসর জমিয়েছে । প্রকৃতি প্রেমিরা গ্রাম্য বিশুদ্ধ প্রকৃতির রূপ–গুণে মুগ্ধতা খুঁজছে । দিল–মন উজাড় করে হাসছেও আবার অনেকে। এই কারো হাসি আর কারো কান্নার মধ্য দিয়েই অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনার স্বীকার হলো সবাই । বড় ধরণের একটি নৌকা এসে উঠে যাচ্ছে বর পক্ষের নৌকার উপড় দিয়ে। নৌকা যখন ডুবে যাওয়ার উপক্রম, তখন সবাই সবার প্রাণ বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত। প্রাণ বাঁচাতে সক্ষমও হয়েছে সবাই ; কিন্তু পারেনি সেই মায়মুনা।
প্রতিটা স্বাপ্নিক মেয়ের মতোই যার ইচ্ছে ছিলো স্বামীর হৃদ নগরের পায়রা হয়ে ওঠার। স্বামীর কানে নিজের অব্যক্ত সব কথা ফিসফিস করে বলে ফেলার। স্বামীকে ভালোবাসার রশি দিয়ে কাছে টেনে নিজ হৃদয়ে গেঁথে নেয়ার।
এখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। নিরবিচ্ছিন্ন ঝুম বৃষ্টি। যেনো কতো কাল থেকে আকাশ কাঁদে না। হৃদ জমিনের গোপন কোথাও জমিয়ে রেখেছিলো সব শোক; তাই আজ কাঁদছে, নিজের মতো করেই কাঁদছে।