সম্প্রতি তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) তিন দফায় ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। এই পদক্ষেপটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি এক গভীর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্পাদক পরিষদ এর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে, যা তাদের ভাষায় “গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতের অন্তরায়”। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং একটি নতুন অন্ধকারের দিকে ইঙ্গিত করছে।
তথ্য অধিদপ্তরের এই পদক্ষেপে এমন অনেক সাংবাদিক ও সম্পাদককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ ধরনের পদক্ষেপ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় মারাত্মক আঘাত হানছে, কারণ একে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরির প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধুমাত্র খবর পরিবেশন নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জন এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা। যদি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়, তবে তা পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে।
সম্পাদক পরিষদ সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছে যে, কোনো সাংবাদিক যদি তার অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের অপব্যবহার করে, তাহলে সেটি রিভিউ করার অধিকার তথ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে। কিন্তু, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা অপরাধের প্রমাণ ছাড়াই একের পর এক কার্ড বাতিল করা, এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার একটি সরাসরি পদক্ষেপ। এ ধরনের মনোভাব সংবাদমাধ্যমের উপর চাপ সৃষ্টি করবে, এবং এটি কার্যকরভাবে সেন্সরশিপ ও নিয়ন্ত্রণবাদী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে—যা গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনাকে বিপন্ন করবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ওপর বড্ড বেশি নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়েছে। কিন্তু, সেসময়ও সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সংগ্রাম চলেছিল তাদের স্বাধীনতার জন্য। এখন, যখন ২০২৫ সালে একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তখন এমন পদক্ষেপ আবারও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মতো এক নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছে।
সম্পাদক পরিষদের আহ্বান সঙ্গত। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ ছাড়া এমন ঢালাও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর অবিচার করা হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে অবশ্যই এই ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সরকারের সকল আক্রমণ থেকে গণমাধ্যমকে রক্ষা করতে হবে। দেশের গণতন্ত্র এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য স্বাধীন সাংবাদিকতা একটি অপরিহার্য উপাদান।
অবশ্যই, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হতে হবে, যাতে তা জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে এবং রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমের যথাযথ প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। যে দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, সেখানে গণতন্ত্র অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং জনগণের তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা শুধু সাংবাদিকদেরই নয়, দেশের গণতন্ত্রেরও এক গুরুত্বপূর্ণ দায়বদ্ধতা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যথায় গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণবাদী মনোভাবই একদিন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে।