তখন ফাল্গুন মাস। মাথার ওপরে সূর্য নেমে এসেছে। দুর প্রান্তরে বট আর তাল গাছ, উপরে কয়েকটি বাজপাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভূবন সরকার দরজা খুলতেই চোখে পড়লো মাঠের দৃশ্যটি। বাড়ির উঠানের গা ঘেসে একটি বিশাল প্রান্তর। প্রান্তরের বুক চিড়ে একটি কাঁচা সড়ক চলে গেছে শ্যামগঞ্জ হাটে। একটু পরেই ভূবন কে যেতে হবে হাটে, আজ হাটবার সপ্তাহে দুদিন হাট বসে।
সারা এলাকায় একটি বড় হাট। সেই পাল জমিদাররা এটির সূচনা করে গেছেন। যাক সে কথা, ক’দিন বাজার করা হয়নি। দেশের যে পরিস্থিতি তার জন্য সব সময় বাজারে যাওয়া কেমন যেন লাগে। তবুও আজ হাটে যাওয়ার খুব তাড়া আছে তার। প্রাইমারী শিক্ষকের পদ থেকে অবসর নিয়ে নিজ বাড়িতেই থাকেন তিনি। সাদা সিধে লোক। কারো সাতে পাঁচে নেই। গ্রামের কোন ঘটনা ঘটলে তিনি ঘর থেকে বাইরে বের হননা।
হাটে যাওয়ার জন্য ধুতি আর প্রিয় খদ্দরের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে কাঁচা সড়কের পা বাড়াতেই মাথায় সব চিন্তা এসে জড়ো হয়। ক’ দিন ধরে বিবিসি রেডিওর খবরে তিনি বেশ চিন্তিত; ইদানিং ঢাকার খবরগুলি পাওয়া যায়না, পোষ্ট অফিসে নিয়মিত পত্রিকাও আসে না। হাটের শেষ প্রান্তে বটগাছের নীচে জমিদারদের সেই জীর্ণ পোষ্ট অফিসে তার নামে বুকপোষ্টে একটি করে দৈনিক পত্রিকা আসে। আজ হয়তো সবগুলি পত্রিকা এক সাথে পাবে, তাতেই মিলবে সব খবর। উত্তপ্ত ঢাকার খবর পেতে তিনি দ্রুত পায়ে হাটতে থাকেন হাটের পথে।
আজ হাটবার নেতার ডিসপেন্সারিতে বসলে মিলবে অনেক টাটকা খবর। আগামী দিনের কর্মসূচি কি? শেখ মুজিব কি ঘোষনা দিলো? কি হবে আগামী দিনে । এ সব মিলবে নেতার ডিসপেনসারীতে। গরম গরম আলাপের সাথে ধুঁয়া উঠা চায়ের আসর বসবে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ভূবন হাটে ঢুকে পড়ে।
নেতার কাছে যাওয়ার আগে ইউনিয়ন বোর্ড অফিস পার হয়ে যেতে হয়। কিন্তু এতেই তো বিপদ; চেয়ারম্যান তো পাক্কা মুসলিমলীগের কিরা খাওয়া নেতা। জিন্নার ছবি টাঙ্গিয়ে সব সময় পাকিস্তানের গুণ কির্তন করতে ব্যাস্ত। বোর্ড অফিসেতো মৌলানা আর মুসলিম লীগ নেতাদের আড্ডার স্থল হয়ে উঠেছে। ও টা পাশ কাটিয়ে যেতে পারেেলই বাঁচা যাবে। এ সব ভাবতে ভাবতে ভগবানের নাম জপতে জপতে ভুবন দ্রুত্র পায়ে হেঁটে চলছে।
ভূবন সরকার ইউনিয়ন বোর্ড অফিস পাশ কাটিয়ে হাটে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু হাটে যাওয়ার রাস্তা তো মাঠ পেরোলেই বড় বট গাছ, তার নীচে ছোট্ট একটি প্রাচীন মন্দির। পাশে পাল জমিদারদের বাগান বাড়ি, তার কাছেই দীঘির আকৃতির পুকুর। সেই অখন্ড ভারত ভাগ হওয়ার সময় এই এলাকা থেকে দলে দলে হিন্দু লোক ভারতে চলে গেছে। কিছু হিন্দু পরিবার বাজারের আশপাশ এখনো বসবাস করছে। ভূবনের মাথায় নানান চিন্তা এসে আবার ঘুরপাক করতে থাকে। আবার হয়তো আরেকটি রায়ট হবে। শেখ মুজিব নাকি ঢাকায় জনসভা করে স্বাধিনতার ডাক দিয়েছেন। হাটে এই খবর আজ সয়লাব হয়ে গেছে। ক‘বে যে শুরু হয় যুদ্ধ।
এই সব চিন্তা নিয়ে হাটে ঢুকতেই নেতার ডিসপেন্সারিতে আওয়ামী লীগের নেতারা সরব হয়ে উঠেছে। জুরুরী সভা করেছে। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে যুবকদের উৎবুদ্ধ করা হচ্ছে। স্থানীয় এমপি আর আওয়ামীলীগের সভাপতি চিঠি দিয়েছেন। তাই নেতার অফিসে অনেক ভীড়। প্রচুর ভীড়ঠেলে টাটকা খবর টি নিয়ে ভূবন আবার হাটে ঢুকে। মনে মনে বলে একটি দেশ ভাগ হলে কতোজনের জীবন যায় তা দেখেছেন ভূবন। সাতচল্লিশে তার পরিবারের অনেকের জীবন গেছে,গেছে সহায় সম্পত্তি।
এই ভেবে বাজার শেষ করে মসল্লার দোকানে যেতেই স্থানীয় আলিয়া মাদ্রসার বড় হুজুর মৌলানা জহির এক রকম গায়ের জোরে ধাক্কা দিলে বলে ‘‘ এখনো আছেন বাবু, ইন্ডিয়া যাননি’’; কথাটি শুনেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়, চমকে উঠে এক রকম অপ্রস্তুত হয়েই হেসেই কুসল বিনিময় করে কোন মতো কেটে পড়েন ভূবন বাবু। আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু বার বার মৌলানার কথাটি মনে ভেসে উঠে। আবার স্মৃতিগুলি মাথায় আসতে থাকে, এই গ্রামে তাদের সাত পুরুষের বাস ছিলো। দাদা স্বদেশী আন্দোলনের নেতা ছিলেন, তিনি জেল জুলুম হুলিয়ে উপেক্ষা করে স্বদেশী আন্দোলন করে আন্দামানের কালা পানিতে বন্দি ছিলেন। ইংরেজদের ভয়ে তবুও এই গ্রাম ছেড়ে যাননি। অথচ আজকের এই মৌলানা কি ভাবে হুমকি দিলো। কথাটি মনে মনে ভাবতে ভাবতে পোস্ট অফিসের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। পোস্ট মাস্টার ধিরেন্দ্র বসাক বসে আছে, কিছুক্ষন আগে রাধানাথ রানার রেল স্টেশন থেকে ডাক নিয়ে ফিরেছে। নিয়মিত ডাক এখন আসছেনা। ভাটারা স্টেশন পাক আর্মিরা ক্যাম্প করেছে। বাউসিতে ছাওনী ফেলে চলাচল কড়াকড়ী করেছে। মাঝে মাঝে রেল স্টেশন থেকে রানার কে খালি হাতে ফিরতে হয়। আজ ডাক এসেছে। এসেছে অনেকগুলি পত্রিকা। সবগুলি বগলদাবা করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরেছেন ভূবন। হেরিকেনের আলোয় পত্রিকা খুলতেই পত্রিকার পাতাজুড়ে শেখ মুজিবের হাত উঁচু করা ছবি,বড়বড় অক্ষরে সংবাদ শিরোনাম এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধিনতার সংগ্রাম…’’। খবরটি পড়তে পড়তে ভূবন ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল থেকে গ্রামের চিত্রটা কেমন যেন পাল্টে গেছে সবখানে শুনশান পরিবেশ। সবার মাঝে আতংক। চেয়ারম্যানের লোকেরা গুজব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। হিন্দু পরিবারগুলি দেশত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওপারে যাবে তাতেই বেঁচে যাবে। এই ধারনা থেকেই লোকেরা ওপারে পাড়ি দিতে চাচ্ছে। গ্রামের মুসলিমলীগ নেতারা হিন্দুদের আর আওয়ামী লীগ কর্মীদের তালিকা করে রেখেছেন। অনেকে ভূবনকে ওপারে যাওয়ার পরমর্শ দিতে আসলে তিনি সাব জানিয়ে দেন আমি মরলে এ দেশেই মরবো। এই আতংক আর শঙ্কার মধ্যেই কেটে যায় কটা দিন।
এক সকালে মন্দিরের পুজা শেষে খবর পেলো দলে দলে লোক ওপারে চলে গেছে। কাল রাতে তারা এলাকার পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে চলে গেছে। অল্প কিছু পরিবার এখনো আছে। কিন্তু তারাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভূবন বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখে সাহা পাড়া, কৈবত্যপাড়া, ঠাকুর বাড়িতে কেউ নেই । বড় বড় ঘরগুলি ছেড়ে হাতে জমানো সামান্য সম্বল নিয়ে তারা পাড়ি দিয়েছেন ওপারে। এই দৃশ্য দেখে ভূবন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখে, একঝাাঁক শুভ্র পায়রার দল কার জানি খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যাচ্ছে। মন্ডল বাড়ির যুবকরা কৈবত্যদের বড় জলপাই গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। মিয়া পাড়ার ছেলেরা সাহাদের বাগানের ফুলগাছ তুলে নিয়ে যাচ্ছে,মন্দিরের ত্রিশূলটাও রক্ষা পায়নি, রক্ষা পায়নি মন্দিরের তুলসির গাছটিও; মোল্লাবাড়ির ঝি বৌরা শিশুর সামান্য সর্দি সারাতে মন্দিরের তুলসির গাছ কেটে দিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু হরি লুটের বাতাসার মতো লুটপাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই দৃশ্য দেখে বুক ভারী হয়ে আসে ভূবনের। মাথাটি ঘুরে যায় যুদ্ধের দামামা কানের কাছে বাজতে থাকে, শরীর জুড়ে রাজ্যের ঘাম চলে আসে, চোখ অন্ধকার করে বসে পড়ে মাটিতে।
একটু পরেই গুঞ্জণ ছড়িয়ে পড়ে হানাদার রা নাকি ভটারা রেল স্টেশনে নেমেছে। তারা শ্যামগঞ্জ বাজারে আসেবে। খাকি পোষাকে শতশত হানাদার রেল বাজারে অবস্থান নিয়েছে। ঝিনাই নদীর রেল ব্রীজটা খুব গুরত্বপূর্ণ। তাই এই ব্রীজ রক্ষাত্বে এতো মিলিটারী এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা সময় মতো ঝিনাই ব্রীজটি উড়তে পারে নাই। পাশে কটি হিন্দু প্রধান গ্রামেই তাদের টার্গেট।
এক সকালে সকলের অজান্তে হানাদার রা শ্যামগঞ্জে ঢুকে পড়ে গ্রামে গ্রামে তাদের দোষররা লুটপাট চালায়। গ্রামের পর গ্রাম জ¦ালিয়ে দেয়। একটু এগিয়ে যায় তারা বাজার থেকে কিছু দূরে গেছে কাঁচা রাস্তায় তাদের জীপগুলি আটকে যায়। তারা থানা সদেরের রাস্তা খুঁজে। তারা গ্রামে ঢোকার খবরে সারা গ্রাম জনশূণ্য হয়ে পড়েছে প্রায়।
কাউকে কাছে পাচ্ছে না। এমন সময় একজন লোককে তারা হাত ইশারায় ডাকে প্রতিবন্ধি মেছের এগিয়ে আসে। উদ্দু উচ্চারনে তাকে কিছু একটা জিঞ্জাসা করলে সে উত্তর না দিয়ে ঠাই দাড়িয়ে থাকে। কয়েকবার জিঞ্জাসার পর এক হানাদার তাকে একটি চড় মারে। মেছের রেগে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ইট দিয়ে ঠিল ছুটলে হানাদারের মাথাফেটে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়। পাকি হানাদার রা তাকে মুক্তি মুক্তি বলে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এই দৃশ্য দেখে মেছের এর ভাইসহ কয়েক যুবক প্রতিবাদ করলে ছযজন যুবককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে পুরো গ্রামটিকে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। এবং নির্বিচারে গুলি চালাতে চালাতে তারা হিন্দু পাড়াতে আবার হামলা করে এবং ভূবন কে হত্যা করে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যায়।
তখন সবুজ ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে লাল টকটকে সূর্যটা পটে যাচ্ছিলো। তার লাল আভাটা অনেকাংশে ঢাকা পড়েছে অগ্নিকান্ডের কালো ধুঁয়ায়। সূর্য্যটা অস্ত যাচ্ছে চারিদিকে অন্ধকার হাতছানী দিয়ে ডাকছে রাতের আধার কে। মেঠো পথে পড়ে আছে আলোর পথযাত্রীরা।